সম্প্রতি বাংলাদেশে বিভিন্ন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিভিন্ন ধরণের প্রতারনার ঘটনা সংঘটনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাতের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার নজির পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়াও, বেশ কিছু এমএলএম প্রতিষ্ঠান বর্তমানে এদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে যা অদূর ভবিষ্যতে বিশাল আকার ধারণ করে প্রচুর অর্থ আত্মসাতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে মর্মে প্রতীয়মান হয়। সম্প্রতি অনপেসিভ নামক এরূপ একটি এমএলএম প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি এ ইউনিটের নজরে এসেছে।
অনপেসিভ এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (www.ompassive.com) হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে এটি একটি সফটওয়্যার ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানি যারা ২০১৮ সাল থেকে ইমেইল, অনলাইন মিটিং ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন সফটওয়্যার/প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য বেশ কিছু সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থিত। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরে- অনপেসিভ এর রেজিস্ট্রার্ড অফিস রয়েছে।
যেসব সফটওয়্যার/প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনপেসিভ কাজ করছে তা নিম্নরূপঃ
ও-কানেক্ট (ভার্চুয়াল সভা আয়োজন প্ল্যাটফর্ম যা জুম, গুগল মিট ইত্যাদির বিকল্প), ও-নেট (ফেসবুক, টুইটার এর বিকল্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম), ও-মেইল (জিমেইল এর বিকল্প), ও-ট্রিম (ইউআরএল শর্টেনার), ও-ভেরিফাই (কেওয়াইসি সেবা), ও-ট্র্যাকার (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন এবং ওয়েবসাইট ভিজিটর ট্র্যাকার)।
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও এখন পর্যন্ত তারা কার্যকরভাবে কোন সফটওয়্যার/প্ল্যাটফর্ম বাজারে চালু করতে পারেনি। তবে, অনপেসিভ ২০১৮ সাল হতে তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য বিনিয়োগকারীদের নিকট হতে অর্থ সংগ্রহ করছে। ৯৭ মার্কিন ডলার প্রদান করে অনপেসিড এর ফাউন্ডার পদবী পাওয়া যায় এবং উক্ত ৯৭ মার্কিন ডলার সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীর অনপেসিভ ওয়ালেটে রক্ষিত থাকে। পরবর্তীতে অনপেসিভ কোন পন্য বাজারে ছাড়লে উক্ত পণ্যের সাবস্ক্রিপশন ফি হাতে প্রাপ্ত আয় হতে ফাউন্ডারবৃন্দ একটি অংশ পাবেন মর্মে ফাউন্ডারবৃন্দকে জানানো হয়েছে। এছাড়াও, অন্যান্য এমএলএম ব্যবসার মতো এখানেও রেফারেল কমিশন পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে অনপেসিভ-এর কয়েক হাজার বিনিয়োগকারী রয়েছেন।
২০২২ সালে অনপেসিভ এর দুই হাজার জন বাংলাদেশী বিনিয়োগকারী ঢাকায় একত্রিত হয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন মর্মে টেলিভিশন ও অন্যান্য মিডিয়াতে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। জুন, ২০২২ সালের পর হতে অনপসিভে আর কোন ফাউন্ডার নেয়া হচ্ছেনা। তবে জুন, ২০২২ সাল পর্যন্ত অনপেসিভ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১১.২০ লক্ষ ফাউন্ডারের নিকট হতে ১০৮ (একশত) মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে। তবে, এখন পর্যন্ত অনপেসিভ হতে কোন বিনিয়োগকারী কোন মুনাফা অর্জন করতে পারেন নি।
অনপেসিভ এর মূল উদ্যোক্তা জনাব আশরাফ মুফারেহ (যিনি এশ মুফারেহ নামে পরিচিত), একজন মার্কিন নাগরিক। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে জেমস কিং নামক এক ব্যক্তির সাথে যোগসাজসে একটি পঞ্জি স্কিম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে জনাব আশরাফ মুফারেহ এর বিরুদ্ধে। সংবাদ মাধ্যম হতে জানা যায়, জনাব জেমস কিং যুক্তরাজ্যে ব্যানার্স ব্রোকার নামক একটি পঞ্জি স্কিম পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও, ২০১০/২০১১ সালে ব্রাজিলে এশম্যাক্স, ২০১২ সালে টেলেক্সফ্রি এবং ২০১৮ সাথে পে ডায়মন্ড নামক পঞ্জি স্কিম পরিচালনার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ছিলেন জনাব আশরাফ মুফারেহ। বর্ণিত সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২০১৮ সালে তিনি অনপেসিভ প্রতিষ্ঠা করেন।
ফাউন্ডারদের বিশ্বাস অর্জনের লক্ষ্যে অনপেসিভ সাম্প্রতিক সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরতের বুর্জ খলিফা টাওয়ারে নিজেদের নামে লাইট শো এর আয়োজন করেছে এবং দুবাই এর একটি মেট্রো স্টেশনের নাম অনপেসিভের নামে নামকরন করা হয়েছে। তবে অনপেসিভ ও এর প্রতিষ্ঠাতা জনাব আশরাফ মুফারেহ কর্তৃক প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন চলতি বছরের (১১ আগস্ট) অনপেসিভ এলএলসি (গোফাউন্ডার এবং ওফাউন্ডার নামেও প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত) এবং আশরাফ মুফারেহ ও তার স্ত্রী আসমাহান মুফারেহ এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
সূত্রে জানা যায়, অনপেসিভ সম্প্রতি তাদের প্রথম পন্য "ও-কানেক্ট" বাজারে চালু করেছে সুত্রে জানা যায়। পন্যটি মূলত ভার্চুয়াল সভা আয়োজন প্ল্যাটফর্ম হলেও পন্যটির গ্রাহকরা এটি ক্রয়ের পর অন্য কারো নিকট বিক্রয় করে মুনাফা অর্জন করতে পারার বিষয়টিকেই তাদের ওয়েবসাইটে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা হয়েছে। অর্থাৎ, পন্যটি অন্যান্য এমএলএম কোম্পানির পণ্যসমূহের মতই কেবল হাত বদলের উদ্দ্যেশ্যে বাজারে আনা হয়েছে। উক্ত পন্যের জন্য সকল ফাউন্ডারদের ২৫০ (দুইশত পঞ্চাশ) মার্কিন ডলার করে বিনিয়োগ করার জন্য অনপেসিভের পক্ষ হতে আহবান জানানো হয়। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অনপেসিভ এর বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারীদের মধ্য হতে অনেকেই ২৫০ (দুইশত পঞ্চাশ) মার্কিন ডলার করে বিনিয়োগ করেছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অনপেসিভ তাদের অন্যান্য প্রোডাক্টগুলোও চালু করবে। বাংলাদেশে অনপেসিভ এর বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারী থাকায় উক্ত প্রোডাক্টসমূহে এদেশের জনগন বিনিয়োগ করলে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ হতে বিদেশে পাচার হয়ে যেতে পারে এবং প্রতারণার শিকার হওয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীগণ বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন মর্মে প্রতীয়মান হয়। অনপেসিভ এর প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে পঞ্জি স্কিম পরিচালনার নজির থাকায় এবং অনপেসিভ ও এর প্রতিষ্ঠাতা সর্বজনাব আশরাফ মুফারেহ ও তার স্ত্রী আসমাহান মুফারেহ এর বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক মামলা দায়ের করায় এ বিষয়ে অন্তঃগভীর অনুসন্ধান ও তদন্ত আবশ্যক।
বাংলাদেশে বিভিন্ন পঞ্জি স্কিম বা মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ সতর্কবার্তা জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইতিপূর্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন পত্তি স্কিম বা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ঘটনা সংঘটনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা সংঘঠিত হওয়ার নজির পরিলক্ষিত হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্প্রতি আনপেসিড (www.onpassive.com) নামক অনুরূপ একটি এমএলএম প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি নজরে এসেছে। অনপেসিভ নামক এ পঞ্জি স্কিমে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী প্রতারণা একটি সম্পৃক্ত অপরাধ উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনপেসিভ বা এ ধরনের প্রতারণামূলক পঞ্জি স্কিমে বিনিয়োগ, লেনদেন, লেনদেনে সহায়তা প্রদান ও প্রচার করে অপরাধ সংঘটন হতে বিরত থাকার জন্য সকলকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থসংবাদ/কাফি