বর্তমান বাজারের গতি-প্রকৃতি দেখে আমরা বলতে পারি, পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরে এসেছে। যাদের হাতে টাকা আছে তারা সবাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। এরই প্রতিফলন আমরা এক্সচেঞ্জের টার্নওভারে দেখতে পাচ্ছি। আমরা তিন বছরের মধ্যে ডেইলি টার্নওভার পাঁচ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। শুধু ইকুইটি মার্কেটের ওপর নির্ভর না হয়ে নতুন নতুন বিভিন্ন প্রডাক্ট বাজারে নিয়ে আসার জন্য বিএসইসি ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সিসিপি চালু হচ্ছে, দ্রুততার সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন নতুন প্রডাক্টস, সুকুক ডেরিভেটিভস/ফিউচার চালুর প্রচেষ্টা জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এসএমই প্ল্যাটফর্ম ডিএসই তৈরি করে ফেলেছে। সরকারি ভালো ভালো শেয়ার বাজারে এনে বাজারের গভীরতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। দেশীয় ভালো ভালো প্রাইভেট কম্পানির শেয়ার এবং মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির শেয়ার বাজারে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সফল, সৎ ও দক্ষ উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগ্রহ বাড়ছে। বন্ড মার্কেট শক্তিশালী হচ্ছে। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোতে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে।
আগামী তিন বছরের মধ্যে জিডিপিতে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশনের অবদান ৫০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিএসইসি ও এক্সচেঞ্জ এগিয়ে যাচ্ছে। বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসছে। বাজারে আস্থা ধরে রাখতে বিএসইসি কমিশনকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। বিএসইসি কোনো অবস্থায়ই বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করবে না, ইনডেক্সকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। শেয়ারের দাম ওঠা-নামা করলে ইনডেক্স বাড়ে এবং কমে। সেটাই স্বাভাবিক। বাজারে ফ্রি ফ্লোট শেয়ার বেশি থাকলে বাজার স্বাভাবিক থাকে। ফ্রি ফ্লোট শেয়ার যে কম্পানির বেশি থাকে সে কম্পানির শেয়ার ম্যানিপুলেট করে বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ যেসব কম্পানির মৌল ভিত্তি ভালো এবং ফ্রি ফ্লোট শেয়ার বেশি তারা নিজস্ব স্ট্রেংথে বাড়ে। এসব শেয়ারের ইপিএস, পিই, রেশিও, রিজার্ভ, বিজনেস এক্সপেনসন, কোম্পানি মূলধন, দক্ষ পরিকল্পনা ও পরিচালনার কারণে পরিপক্ক বিনিয়োগকারী বেশি বেশি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী থাকে। অন্যদিকে ‘জেড’ গ্রুপের শেয়ার, স্মল পেইড-আপ ক্যাপিটাল শেয়ার, নন-পারফরম্যান্স শেয়ারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ম্যানিপুলেশন করে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ম্যানিপুলেট করে সহজে বাড়িয়ে নেওয়া যায়। এসব কম্পানির লেনদেনের ক্ষেত্রে বিএসইসি ও এক্সচেঞ্জকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। বাজারকে এগিয়ে নিতে হলে লিস্টেড কম্পানিগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা বিশেষ জরুরি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ২৪ শতাংশ হোল্ড করে এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এসব প্রতিষ্ঠানের ফ্রি ফ্লোট শেয়ার অনেক বেশি। বিনিয়োগকারীদের হাতে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার আছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে বিএসইসিকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। এখনো অনেক ব্যাংকের স্পন্সর বা ডিরেক্টররা ব্যাংকগুলোকে তাঁদের পারিবারিক সম্পত্তি মনে করেন, তাঁরা এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। অনেক সময় তাঁরা নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করেন না
বাজারের গতিশীলতা ধরে রাখতে হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংকে যাঁরা স্পন্সর বা ডিরেক্টর আছেন তাঁদের বুঝতে হবে তাঁরা ব্যাংকের মালিক নন, শেয়ারহোল্ডার। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ থেকে এই সব স্পন্সর বা ডিরেক্টরকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাংক ডিপোজিটরদের টাকায় চলে, সেসব পরিচালকের টাকায় চলে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ব্যাংকের উদ্যোক্তা, পরিচালকরা ২০০৯-১০ সালে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে, ১০ টাকার শেয়ার মার্কেটে ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন এবং হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। বর্তমানে সেসব শেয়ারের দাম ফেসভ্যালু, ১০ টাকার নিচে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে বিএসইসিকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। এখনো অনেক ব্যাংকের স্পন্সর বা ডিরেক্টররা ব্যাংকগুলোকে তাঁদের পারিবারিক সম্পত্তি মনে করেন, তাঁরা এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। অনেক সময় তাঁরা নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বতন্ত্র পরিচালকদের মতামতেরও তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসি কমিশন/বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ উদ্যোগ নেবে, যাতে ব্যাংকগুলো তাদের প্রতিটি মিটিংয়ের কার্যবিবরণ মিনিট আকারে রাখে এবং তা সংরক্ষণ করে।
বিএসইসি কমিশন, সেন্ট্রাল ব্যাংক একসঙ্গে কাজ করে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। সৎ ও পেশাদার ক্ষুদ্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। যেসব বিনিয়োগকারী এবং প্রতিষ্ঠানের ২ শতাংশ শেয়ার আছে তাদের পরিচালনা পর্ষদে সহজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্পন্সর, ডিরেক্টরদের কোনো ওজর-আপত্তি চলবে না। কারণ আমরা বাস্তবে দেখি স্পন্সর-ডিরেক্টররা তাঁদের পছন্দমতো পরিচালক নিয়োগ দিতে চান, এটা বন্ধ করতে হবে। যাদের ২ শতাংশ শেয়ার আছে তাদের অটোমেটিক্যালি বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথ করে দিতে হবে। এতে স্বতন্ত্র পরিচালক এবং শেয়ারহোল্ডার পরিচালকদের যৌথ পরিচালনায় ব্যাংকগুলো দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা দূর হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়বে। তাতে বাজার আরো ভালো ও বড় হবে। ব্যাংকের লেনদেন আরো বাড়বে।
সবাইকে বুঝতে হবে ব্যাংক ব্যবস্থা যত ভালো থাকবে দেশের অর্থনীতি তত ভালো থাকবে। পুঁজিবাজারও ভালো থাকবে। এখনই উপযুক্ত সময় সব কিছু ঠিকঠাক করার। ঋণখেলাপিকে কঠোর আইনের আওতায় এনে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের লাইফস্টাইলে হাত দিতে হবে। দেউলিয়া আইনের সংশোধন করে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন দেশ, চীন, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি থেকে ৭০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সফল অর্থমন্ত্রীকে এই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে বলব, আপনার সফলতা দিন দিন বাড়ছে। অনুরোধ করব অর্থনীতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই জায়গায় বাস্তবতার আলোকে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।
বিনিয়োগকারী কোন সময়ে, কোন দামে শেয়ার কিনবে এটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। পৃথিবীর সব দেশে শেয়ারের দাম বাড়ে এবং কমে। ডিমান্ড/সাপ্লাইয়ের ওপর শেয়ারের দাম নির্ভর করে, বিএসইসি কোন সময় কোন শেয়ারের দাম কত হবে তা নির্ধারণ করতে পারে না এবং এটা বলতে পারে না যে কোনো শেয়ারের দাম এত বৃদ্ধির ফলে পরবর্তী এক মাস তার মূল্যবৃদ্ধির তদারক করতে। বিএসইসির মূল কাজটা হলো বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, আইন, রুলস, রেগুলেশনসের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, ইনসাইডার ট্রেড বা মার্কেট ম্যানিপুলেশন বন্ধ করা। লিস্টেড কম্পানিসহ ব্রোকারস, যারা পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের সবাইকে কঠোর কমপ্লায়েন্সের মধ্যে রাখা। বিএসইসি বলবে না কোন কম্পানির শেয়ার ভালো, কোন সেক্টরের শেয়ারগুলো ভালো হবে। এটা বিএসইসির কাজ না। বিনিয়োগকারী ঠিক করবে সে কী পাবে। এটা তার দায়িত্ব। আমাদের আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলতে হবে, নিজের সুবিধামতো কোনো আইন তৈরি করা যাবে না এবং কাউকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া যাবে না।
যেসব কম্পানির ফ্রি ফ্লোট শেয়ার বেশি সেগুলোর ম্যানিপুলেশন করে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি করা প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, এখন তো ব্যাংকের টাকা তার নিয়মের মধ্যে থেকে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, ম্যানিপুলেশন কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আমি মনে করি, এই সকল বিনিয়োগকারী সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করছে। বড় বড় বিনিয়োগকারীর সুবিধা হলো, ভালো শেয়ার তারা যে দামেই কিনুক না কেন শেয়ারের দাম যদি পড়েও যায় তারা চিন্তিত হয় না। কারণ তারা শেয়ারটা ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে।
পুঁজিবাজারের ইতিহাসে দেখা গেল একটি ভালো এবং ফান্ডামেন্টাল শেয়ারের দাম পড়ে গেলেও পরে তার দাম আবারও বাড়ে। অতএব ভয় হলো শুধু ছোট বিনিয়োগকারীদের, যারা স্বল্প পুঁজি নিয়ে বাজারে আসে, যারা বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করতে চায় না এবং অল্প সময়ে লাভ করতে চায়। তাদের জন্য সবচেয়ে রিস্ক থেকে যায়। আমি বারবার বলছি, যারা স্বল্প টাকা নিয়ে পুঁজিবাজারে আসবে তারা যেন সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করে।
বিএসইসি কমিশন বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করেছে। অতএব আপনার দায়িত্ব আপনার কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের একটি অংশ পুঁজিবাজারে দক্ষতার সঙ্গে বিনিয়োগ করুন। আশা করি আপনি লাভবান হবেন। শুধু বুঝবেন, টাকাটা যেহেতু আপনার, দিনের শেষে লাভও আপনার, লোকসানও আপনার। এখানে কাউকে, বিশেষ করে সরকারকে অথবা বিএসইসি কমিশনকে আপনার দোষারাপ করার কোনো সুযোগ নেই। বাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়াতে, সরকারি ভালো শেয়ার এনে বাজারকে আরো বেশি গতিশীল করতে হবে। পুঁজিবাজার হছে শিল্পায়নে এবং কর্মসংস্থানে টাকার মূল উৎস, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়।
আগামী তিন বছরে দেশের পুঁজিবাজারে পাঁচ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে বলে আশা করি। বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবং তাঁর সফল অর্থমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ হবে। সরকার বড় বড় অবকাঠামোতে যে বিনিয়োগ করবে তা কম্পানিতে রূপান্তর করে, পুঁজিবাজারে তার শেয়ার ছেড়ে জনগণ থেকে টাকা নিয়ে দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী অবদান রাখতে পারবে।
যদি পুঁজিবাজার ভালো থাকে সবচেয়ে লাভবান হবে সরকার। উন্নয়নের জন্য টাকার একটি বড় অংশ আসবে জনগণের সঞ্চয় থেকে। এতে জনগণের সঞ্চয়ের টাকা আনপ্রডাক্টিভ খাত, যেমন জমিজমায় বিনিয়োগ কম হবে অথবা টাকা বিদেশে পাচার হবে না। এটাই হবে সরকারের বড় সাফল্য।
লেখক: মো. রকিবুর রহমান
সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড