“আমাদের আবার দেখা হবে,” রানি এলিজাবেথ ১৯৩৯ সালের একটা গানের অনুষঙ্গেই সম্প্রতি এ কথা বললেন। তাঁর এই কথার পিছনে একটা অনুপ্রেরণামূলক প্রণোদন ছিল, এটাই আমরা চাইছিলাম। কিন্তু এই অতিমারি শেষ হলে আবার যখন আমাদের দেখা হবে, কেমন পৃথিবী দেখব আমরা? আমরা কি যৌথ ভাবে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা থেকে নতুন কিছু লাভ করব?
করোনাভাইরাসের আগেও পৃথিবী গুরুতর সব সমস্যায় পূর্ণ ছিল। দেশে দেশে অসাম্য ছিল লাগামছাড়া, দেশগুলির অভ্যন্তরেও তা লক্ষণীয় ছিল। বিশ্বের ধনীতম দেশ আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা পরিষেবার আওতার বাইরে ছিলেন, আকস্মিক অসুস্থতায় কিছু করার ছিল না। অতিমাত্রায় কঠোরতা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে দুর্বল মানুষের জন্য কিছু করে উঠতে বাধা দিচ্ছিল। ব্রাজিল থেকে বলিভিয়া, পোল্যান্ড থেকে হাঙ্গেরি— সর্বত্র গণতন্ত্র বিরোধী রাজনীতি মাথাচাড়া দিচ্ছিল।
এই অতিমারির বিরুদ্ধে যৌথ ভাবে লড়াই করার অভিজ্ঞতা কি অতিমারির আগেকার এই সব সমস্যার উপশমে সাহায্য করবে?
একসঙ্গে কাজ করার এই প্রয়োজনবোধ নিশ্চিত ভাবে গণ-কর্মকাণ্ডে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ অধিক মাত্রায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরত্বকে বুঝতে পেরেছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জ, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার এবং বিশ্বব্যাঙ্ক ১৯৪৪-’৪৫-এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়। ভেরা লিনের সেই ‘উই উইল মিট এগেইন’ গানটি গাওয়ার খুব বেশি দিন পরের ঘটনা নয় এগুলো।
যাই হোক, এই অভিজ্ঞতা থেকে কোনও দেশ কি দীর্ঘমেয়াদি কোনও উন্নতির শিক্ষা লাভ করতে পারে? আমরা কয়েকটির ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে খাদ্যাভাবের কারণে ইংল্যান্ডে যে অপুষ্টির প্রবাহ তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধের পরে তা দ্রুত কমে আসে। খাবারের জোগানে বিরাট ধস থেকে ইংল্যান্ড রেশনিং ব্যবস্থার দ্বারা ও সামাজিক স্তরে বাধা-নিষেধ আরোপ করে খাদ্যের সমবণ্টন চালু করে। অপুষ্টির ক্রমাগত প্রবাহে তা কাজে আসে। চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এই বণ্টন কাজে আসে।
এ সবের ফল দাঁড়ায় অসাধারণ। ১৯৪০-এর যুদ্ধের দশকে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে সদ্যোজাত ছেলেদের সম্ভাব্য আয়ুসীমা ৬.৫ বছর করে বেড়ে যায়, যা তার আগের দশকে ছিল ১.২ বছর। সদ্যোজাত মেয়েদের ক্ষেত্রে যুদ্ধের দশকে সম্ভাব্য আয়ুসীমা বেড়ে যায় ৭ বছর, যুদ্ধের আগের দশকে যা ১.৫ বছর ছিল। সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও পিছিয়ে থাকা মানুষের দিকে অধিক মাত্রায় নজর দেওয়ার ফলে যা উঠে আসে, আমরা তাকে ‘কল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থা’ বলে থাকি। যুদ্ধের কালে এবং যুদ্ধের পরে সামাজিক ন্যায়ের অন্যতম প্রবক্তা আনেউরি বেভান ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস হাসপাতাল, ম্যানচেস্টারের পার্ক হসপিটালের দ্বারোদ্ঘাটন করেন।
সাম্প্রতিক এই সঙ্কট থেকে কি এমন কিছু ইতিবাচক ঘটনা ঘটতে চলেছে? একটা সঙ্কট থেকে উত্তীর্ণ হতে গিয়ে যে শিক্ষাটা পাওয়া যায়, তা নির্ভর করে কী ভাবে সেই সমস্যার মোকাবিলা করা হল এবং কোন সমস্যাগুলির আশু সমাধান করা হল তার উপর।
এ ক্ষেত্রে রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যার মধ্যে শাসক আর শাসিতের সম্পর্কও বর্তমান। যুদ্ধের সময়ে এক দিকে যদি ইংল্যান্ডে খাদ্যের সুষম বণ্টন আর চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত ঘটে থাকে, তা হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই অন্য দিকে বাংলায় ঘটেছিল ১৯৪৩-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ এই মন্বন্তরে মারা যান, ব্রিটিশ সরকার এই দুর্ভিক্ষ আটকানোর জন্য বিশেষ কিছুই করেনি। সাম্প্রতিক অতিমারির ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টি তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও স্থান অধিকার করে নেই। আমেরিকায় সাদা মানুষের চাইতে অনেক বেশি মাত্রায় কোভিড-১৯-এর শিকার হচ্ছেন আফ্রিকান আমেরিকানরা। শিকাগোয় এই অতিমারিতে যত জন মারা গিয়েছেন, তার মধ্যে ৭০ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকান, যাঁরা মোট বাসিন্দার এক তৃতীয়াংশ। ব্রাজিল বা হাঙ্গেরি অথবা ভারতের মতো দেশে অভ্যন্তরীণ বৈষম্য এই যন্ত্রণার দিনেও কিছু কম নয়।
ভারতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্লেখযোগ্য ভাবে লক্ষণীয়। অসাম্য এখানে বিপুল। স্বাধীনতার পর থেকে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে, এখানে দুর্ভিক্ষ ঘটেনি। তা সত্ত্বেও গণ-সমাজের আলোচনায় উঠে আসা বিষয়গুলি থেকে আঁচ করা যায় বঞ্চিত মানুষের কথা, বিপন্নকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা— ইত্যাদি ব্যাপারে সরকারি স্তরে বিভিন্ন বাধা প্রদান, সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে খর্ব করার কথা।
সচ্ছল মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার অধিকতর সুবন্দোবস্ত এবং তারই পাশাপাশি গরিব মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার একান্ত অভাবের বৈপরীত্য, তার সঙ্গে আধুনিক জাতপাত-ভিত্তিক অসাম্য যুক্ত হয়ে এমন এক অবস্থা হয়ে রয়েছে যে, ভারত এই অতিমারি মোকাবিলা করতে গিয়ে বিপুল ভাবে উপকৃত হতে পারে। যদিও এখনও পর্যন্ত এখানে তেমন সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দেখা যায়নি, বরং হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করে, ট্রেন-বাস বন্ধ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা না ভেবে যা করা হয়েছে, তা অভাবনীয়। দরিদ্রতম এই সম্প্রদায়ের মানুষ নিজের বাড়ি থেকে শত শত মাইল দূরে রীতিমতো বিপাকে পড়ে রইলেন।
এ কথা সত্য যে, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াকে রোধ করতে পারে, কিন্তু এটা প্রয়োগ করতে হলে পরিপূরক ব্যবস্থা প্রয়োজন। লকডাউনের ফলে বিপর্যস্ত মানুষের আয়, খাদ্য, চিকিৎসা ইত্যদি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অনেক দেশের মতো ভারতেরও ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস প্রয়োজন। কিন্তু এই অতিমারি থেকে সে দিকে কোনও প্রবণতা কি দেখা দেবে?
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আবার যখন আমাদের দেখা হবে, আমরা সেই ফেলে আসা অসাম্যের পৃথিবীর থেকে খুব দূরে চলে যাব না। এ ভাবে যাওয়াও হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু এই দুঃসময়ে অনেক দেশেই বিবিধ যন্ত্রণার উপশমের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে খানিক কম অসাম্য-যুক্ত বিশ্বকে গড়ে তোলার এক আদর্শকে লালন করা হচ্ছে। আমরা সঙ্কটের মাঝখানটাও এখনও পার হইনি, এই সময়ে এমন একটা আশা রাখা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে?
আনন্দবাজার এর সৌজন্যে