বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তথা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এরই মধ্যে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার সম্পর্কে বলেছে—যেটা ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কোনো দেশে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হারও দেখা যাবে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হারও ৭-৮ শতাংশের বৃত্ত থেকে একেবারেই দ্রুত নেমে ২-৩ শতাংশে দাঁড়াবে।
২০০৭-০৮ সালে বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা শুরু হয়েছিল প্রথমত যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ধকল কাটতে বেশির ভাগ দেশের সময় লেগেছিল ছয়-সাত বছর। কিছু দেশ, বিশেষ করে ইউরোপের দেশ, এখন পর্যন্ত মন্দার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। করোনাভাইরাসের আক্রমণে অর্থনৈতিক মন্দা হবে আরো ভয়াবহ, এমনকি আরো বেশি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
যেহেতু পুরো বিশ্বব্যবস্থাই বিশ্বায়নের কারণে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তাই বাংলাদেশও বিশ্বমন্দার নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত নয় যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরও বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটা আমাদের জন্য ‘বাহ্যিক আঘাত’ অর্থাৎ ‘এক্সটারনাল শক’। উপরন্তু রয়েছে আমাদের ‘অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ’।
আমি এই লেখায় স্বল্প পরিসরে বিশ্বমন্দার বাহ্যিক আলামতের কয়েকটি দিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করব। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে আমাদের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ, রাজনৈতিক আদর্শ, সুশাসন, জনগণের অংশগ্রহণ—এ বিষয়গুলো আলোচনায় চলে আসবে।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক প্যাকেজগুলো অর্থনীতিকে সচল ও পুনরুজ্জীবনে যথেষ্ট সহায়ক হবে। তবে প্রথম শর্ত হচ্ছে এগুলোর দ্রুত ও সঠিক বাস্তবায়ন। প্যাকেজগুলো তিনটি পর্যায়ে—প্রথম তিন মাস, দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বল্পমেয়াদি আগামী অর্থবছর এবং তৃতীয় পর্যায়ে মধ্যমেয়াদি পরবর্তী তিন অর্থবছরে বাস্তবায়ন করা হবে। অতএব এগুলোর সাফল্যের জন্য প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও বাজারকেন্দ্রিক সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
নিম্নলিখিত কতগুলো সুপারিশ করা হলো যেগুলোতে সমন্বিতভাবে সরকার, বেসরকারি ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, এনজিও ও সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। অবশ্যই আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অন্যান্য দেশের সাহায্য-সহযোগিতাও প্রয়োজন হবে।
১. বর্তমানে ব্যাংকিং খাতকে আরো সুসংহত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। কারণ বেশির ভাগ অর্থনৈতিক প্যাকেজ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল।
২. রফতানি শিল্পগুলোকে অতিদ্রুত সচল ও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে হবে। পোশাক শিল্পের ওপর বেশি নির্ভরশীল না থেকে দ্রুত রফতানি পণ্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সেজন্য প্রণোদনা প্যাকেজও আরো প্রসারিত করতে হবে।
৩. দেশের বন্দরগুলো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, উৎপাদন উপকরণ (গ্যাস, বিদ্যুৎসহ), কাস্টমসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন অঙ্গের দক্ষতা ও কর্মতত্পরতা বাড়াতে হবে।
৪. বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বড় বড় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি ছোট-মাঝারি শিল্প ও ব্যবসা, কৃষি, মত্স্য, পোলট্রি, মত্স্য ও পশুপালন সব ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী মূল্যে ঋণ ও অনুদান দেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সংকুলানমুখী মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যাংকের তারল্য সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখতে হবে। অবশ্য সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি যেন নাগালের বাইরে না যায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৮-এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর বাংলাদেশের ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ব্যাংক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৯.২ শতাংশ, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪.৬ শতাংশ এবং দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫.৮৮ শতাংশ।
৫. সরকারের রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা আরো বাড়াতে হবে এবং প্রয়োজনে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ মোট দেশজ আয়ের ৫ শতাংশের অধিক করা যেতে পারে। একই সঙ্গে সরকারি ব্যয় কমানো, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় কম অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলো বাদ দিয়ে অর্থের সাশ্রয় করা যেতে পারে।
৬. আমদানির ক্ষেত্রে রফতানিমূলক শিল্প ও দেশজ পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ অন্যান্য উপকরণের ওপর ধার্যকৃত ট্যাক্স, শুল্ক যৌক্তিকীকরণ করা যেতে পারে।
পরিশেষে সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিশ্চিত করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হলে এবং তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সৃজনশীলতা ও সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক