রোজা ও ঈদের অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং

রোজা ও ঈদের অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং
রোজা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলিম মিল্লাতের উপর বিশেষ রহমত স্বরূপ। এই মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। আল্লাহ তাআলা এই মাসের সিয়াম সাধনার বিনিময়ে বান্দার গুণাহসমূহ মাফ করে দেন। তিনি রোজাদারদের রোজার বিনিময় নিজ হাতে দিবেন। পবিত্র রমজান মাসে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই রোজা পালন করেন। রোজার শেষে আসে ঈদ উল ফিতর। এই মাসে সংযম সাধনার মাধ্যমে মানুষ মিথ্যা ও কলুষমুক্ত হবেন এটাই রোজার উদ্দেশ্য। কিন্ত রোজা ও ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদের বাজার অর্থনীতি, ব্যাংকিং ও ব্যক্তিগত আর্থিক অভ্যাসে ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা যায়।

উৎপাদন এবং জোগান আগের মত থাকলেও রোজাকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। প্রতিবছরই রোজার শুরুতে এটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয় এ বছর রোজা নির্ভর ছয় পণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। এর মধ্যে রয়েছে খেজুর, ছোলা, চিনি, সয়াবিন তেল, পিয়াজ ও মশুরের ডাল। অন্য এক খবরে দেখা যায় রোজাদারদের সুবিধার জন্য ৮০০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে কাতার সরকার। রমজান মাসের শেষ পর্যন্ত চলবে এ কার্যক্রম। তাদের এ উদ্যোগে সহযোগিতা করছে দেশটির প্রধান শপিংমল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। দাম কমানো পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে মধু, ময়দা, দই, দুগ্ধজাত পণ্য, দুধ, পনির, জুস, চিনি, কফি, খেজুর, খনিজ, বোতলজাত পানি, লেবু, চাল, হিমায়িত শাকসবজি, মুরগি, ডিম, মাংস, ভোজ্যতেল, চা, ঘি, লবণ, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, কাগজের ন্যাপকিন, ডিটারজেন্ট, ময়লার ব্যাগ, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা পণ্য প্রভৃতি।

দুটি মুসলিম রাষ্ট্রে একই উৎসবকে কেন্দ্র করে দুই ধরণের আচরণ। একদিকে অধিক মুনাফার লোভ। অন্যদিকে মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য ত্যাগের অনন্য উদাহরণ। রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষ সীমাহীন কষ্ট ভোগ করে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো অসাধুতা এবং অপরাধ। কিন্তু এ ধরণের কাজ যারা করছেন তারাও অনেকে রোজা পালন করছেন। তওবা করে অসৎ কাজ পরিত্যাগ না করলে মানুষের ইবাদত কবুল হয় না।

ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় খুশির উৎসব। মহান আল্লাহ একমাস রোজা পালনের মাধ্যমে মুমিন বান্দাদের নিষ্পাপ করে দেন। ঈদের দিন সকালে রোজা পালনকারী সদ্যভ‚মিষ্ট শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যান। এতবড় খবরে খুশি না হওয়ার কোন কারণ নেই। সুন্দর জামা কাপড় পরিধান করে সাজগোছ করে ঈদ উদযাপন ইসলামী সংস্কৃতির অংশ। নতুন জামা কাপড় আমাদের ঈদের অন্যতম আকর্ষণ। ব্যবসায়ী নেতাদের মতে আমাদের দেশে ঈদের অর্থনীতির আকার ৫০ হাজার কোটি টাকার উপরে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন ঈদ এবং রোজার বাজার মিলিয়ে এক লাখ ২৫ হজার কোটি টাকারও বেশি অর্থনৈতিক লেনদেন সংঘটিত হয়। শপিংমল এবং বিপনী বিতানগুলোতে জমে ওঠে ঈদের বাজার। ঈদের নতুন পোশাক ছাড়াও, খাবার দাবার, সোনার গয়না, জুতা এবং ঘরের আসবাবপত্রসহ আরো কিছু পণ্যের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। ঈদের বাজারেও ব্যবসায়ীদের অসাধুতার অভিযোগ করেন অনেক ক্রেতা। পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে বিক্রির খবরও পাওয়া যায়।

অনেক রোজাদার মার্কেটে কেনাকাটায় এতটা ব্যস্ত থাকেন যে ফরজ নামাজ এবং পর্দা পরিপালনের বিষয়টি উপেক্ষা করেন। এসব ফরজ ইবাদত ছুটে গেলে রোজার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু থাকবে সেটা বিবেচ্য বিষয়।

ঈদকে কেন্দ্র করে গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন ভাতা প্রদানে সহায়তা করতে ছুটির দিনে অফিস পরিচালনা এবং ইমপোর্ট এক্সপোর্টসহ ব্যবসায়ীদের নানাবিধ বিশেষ সেবা প্রদান করে থাকে ব্যাংকগুলো। কিন্তু ব্যাংকারদের ত্যাগের প্রতিদান কতটুকু মিলছে? ব্যবসা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে গ্রাহকরা যে ঋণ গ্রহণ করে থাকে তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খেলাপী হয়। দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান খেলাপী ঋণের পরিমাণ এক লক্ষ কোটি টাকার উপরে। ঋণ খেলাপীদের বেশিরভাগই নামায রোজা পালনকারী মুসলমান। তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে গড়িমসি করেন। অনেকেই জনগণের টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করেন।

ঋণ পরিশোধ না করার পরিণতি সম্পর্কে আমরা অনেকেই ওয়াকিফহাল না। ইসলামে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পরিশোধের নিয়তে মানুষের সম্পদ গ্রহণ করে, আল্লাহ তাআলা তার পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করে দেন। আর যে তা বিনষ্ট করার নিয়তে গ্রহণ করে থাকে, আল্লাহ তাকে বিনষ্ট করে দেন’।

নবী করিম (সা.) বলেন, ‘মুমিনের আত্মা ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা হয় তার ঋণের কারণে, যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করা হয়।’ অন্যত্র তিনি বলেন, যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, ঋণগ্রস্ত অবস্থায় কেউ যদি আল্লাহর পথে শহীদ হয়, তারপর জীবিত হয়, তারপর শহীদ হয়, তারপর জীবিত হয়, তারপর আবার শহীদ হয়, তবু ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ’

অর্থ আত্মসাৎ ও ঋণ পরিশোধ না করার ব্যাপারে ইসলাম কঠোর শাস্তির হুশিয়ারি দিয়েছে। এটি হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক। বান্দা নিজে ক্ষমা না করলে আল্লাহ তাআলা ঋণের গুণাহ ক্ষমা করবেন না। কিয়ামতের দিন ঋণগ্রহণকারীর সওয়াব পাওনাদারদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। এরপরও যদি তাদের পাওনা পরিশোধ না হয় তখন পাওনাদারদের গুনাহের বোঝা ঋণগ্রহীতাকে দেয়া হবে। গুণাহের বোঝা মাথায় নিয়ে তারা শাস্তি ভোগ করবে। রমজানের এই পবিত্র মাসে আমাদের উচিত আখিরাতে মুক্তির স্বার্থে ঋণ পরিশোধের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাওয়া এবং মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা। কোনোভাবেই ঋণ পরিশোধ সম্ভব না হলে ঋণদাতার কাছ থেকে ক্ষমা করিয়ে নিতে হবে অথবা দায়িত্বশীল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা সংগঠনের শরণাপন্ন হয়ে ঋণ মওকুফ বা পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোভাবেই ঋণ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।

নামাজ রোজার মতই যাকাত ইসলামের আরেকটি ফরজ বিধান। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকদের যাকাত দিতে হবে। যাকাত সম্পদকে পরিশুদ্ধ করে। আল্লাহ তাআলা এর ওপর রহম করেন এবং একে বাড়িয়ে দেন। যাকাত সম্পদের লোভ এবং স্বার্থপরতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। যাকাত গ্রহীতার হৃদয়কেও ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে পরিশুদ্ধ করে এবং দাতার প্রতি তার মনে ভাল ধারণা সৃষ্টি করে। এটি মুমিনদের হৃদয়ের উদারতা বৃদ্ধি করে দেয় এবং তাদের হৃদয়ের স্বার্থপরতা ও লোভ দূর করে দেয়।

দারিদ্র্য দূরীকরণসহ ও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে যাকাত ভ‚মিকা পালন করে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র রমজানে প্রতিটি সৎকাজের বিনিময় অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই অনেকেই পবিত্র রমজানে যাকাত প্রদান করেন অধিক সওয়াবের আশায়। কেউ কেউ শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করেন যাকাতের অর্থ ব্যয় করে। অনেক সময় এসব উপহার গ্রহীতার উপকারে আসে না। বিশেষজ্ঞ আলেমগণ যাকাত হিসেবে নগদ অর্থ প্রদান করাই উত্তম মনে করেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে আদায়যোগ্য যাকাতের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে অনেক বিত্তবান রয়েছেন যারা যাকাত যথাযথভাবে হিসাব করে আদায় করেন না। অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে আদায় করেন। কিছু মানুষ যাকাত আদায় করলেও দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে তা কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিক ভাবে হিসাব করে যাকাত সংগ্রহ করা সম্ভব হলে দারিদ্র দূরীকরণে তা দৃশ্যমান ভ‚মিকা রাখবে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয় বাংলাদেশের জিডিপির ১.৬৩ শতাংশ অবদান রাখতে পারে যাকাত অর্থনীতি।

যাকাতের মতই সাদাকা এক প্রকার আর্থিক ইবাদত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সূরা রূমের ৩৯ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘তোমরা যে দান আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের জন্য করে থাকো তা বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে।’ পবিত্র রমযানে তাই যাকাতের পাশাপাশি অসহায় ও দরিদ্র মানুষকে বেশি পরিমাণে সাদাকা দানের মাধ্যমে তাদের আর্থিক কষ্ট লাঘবের জন্য সম্পদশালীদের এগিয়ে আসতে হবে।

ঋণখেলাপী, মিথ্যাচার, মুনাফাখোরী, মজুদদারীর মত সামাজিক সংকট সৃষ্টিকারী কার্যক্রম মানুষের চরিত্র ও আত্মাকে কলুষিত করে। নবী সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করলো না তার রোজা রাখার আমার কোন প্রয়োজন নেই।’

রোজা, যাকাত ও সাদাকা মানুষের আত্মিক ও আর্থিক পরিশুদ্ধির ইবাদত। পবিত্র এই রমজানে আমরা প্রত্যেকে নিজের দোষত্রুটিগুলো খুঁজে বের করে মহান  স্রষ্টার কাছে তাওবা করে ফিরে আসলে আমাদের দেশের অর্থনৈতি ও সামাজিক জীবন সৌন্দর্যমন্ডিত হবে।

 

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বাণিজ্যিক বিবেচনায়  ‘সৌরবিদ্যুৎ’ টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক
কক্সবাজার: বাংলাদেশে অফুরন্ত পর্যটন সুযোগ উন্মোচন
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
ওএসডি কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে
নেট দুনিয়ার ব্যাংকিং
সর্বজনীন কল্যাণে ইসলামী ব্যাংক: আন্তরিক সেবার ৪০ বছর
সুইডেনের ইনফ্লেশন ১২ শতাংশ, গোল ২ শতাংশ
ব্যাংকের নাম: লিমিটেড থেকে পিএলসি