খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ উপন্যাসের শুরুর লাইনটি পাঠকের সামনে যুগের চিত্র তুলে ধরে নিখুঁতভাবে ‘এটি ছিল সর্বোত্তম সময়, এটি ছিল নিকৃষ্টতম সময়, এটি ছিল জ্ঞানের যুগ, এটি ছিল মূর্খতার যুগ, এটি ছিল বিশ্বাসের যুগ, এটি ছিল অবিশ্বাসের যুগ, এটি ছিল আলোর ঋতু, এটি ছিল অন্ধকারের ঋতু, এটি ছিল আশার বসন্ত, এটি ছিল হতাশার শীত, আমাদের সামনে সবকিছু ছিল, আমাদের সামনে কিছুই ছিল না, আমরা সবাই সরাসরি স্বর্গে যাচ্ছিলাম, আমরা সবাই সরাসরি অন্য পথে যাচ্ছিলাম ---’। ১৮৫৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সংঘটনের পেছনের ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে চার্লস ডিকেন্স এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। প্রথম শিল্প বিপ্লবের শেষ দিকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সামাজিক অসংগতির চিত্র এতে তুলে ধরা হয়েছিল।

আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঊষালগ্নে দাঁড়িয়ে তথ্য প্রযুক্তির সর্বোৎকর্ষ উপভোগ করছি। আমাদের ব্যাংকগুলো শিল্প বিপ্লবের সুফল কাজে লাগাচ্ছে। দ্রুততম, আধুনিক ও উন্নত সেবা নিয়ে উপকৃত হচ্ছেন গ্রাহকগণও। কিন্তু তবুও কেন ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকদের আস্থায় চিড় ধরতে শুরু করেছে। সর্বোচ্চ পরিমাণ আমানত ও বিনিয়োগের পোর্টফোলিও নিয়ে সুশাসনের অভাব, আইন প্রয়োগে অনীহা ও ব্যর্থতা এবং ব্যাংকের স্বার্থ পরিপন্থী নীতিমালা গ্রহণের ফলে প্রায় ডুবতে বসেছে অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ব্যাংক খাত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনকভাবে। কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের জন্য কোন পথ বের করার চেষ্টা না করে উল্টো পথে হাঁটছি আমরা। ঋণ পুনঃ তফসিলের ডাউনপেমেন্ট ৩০ শতাংশের জায়গায় ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, ক্ষেত্র বিশেষে প্রভাব খাটিয়ে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ পুনঃ তফসিল করা হচ্ছে। খেলাপিদের নানান সুবিধা দিতেই যেন ব্যস্ত সবাই। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি বিনিয়োগ বেড়েছে কয়েক গুণ। ২০২২ সালের শেষে সেটা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। তবে প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ আরো অনেক বেশি। বিগত বছরে ব্যাংকগুলো ২ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃ তফসিল করেছে। অর্থাৎ এই পরিমাণ খেলাপি বিনিয়োগ বিশেষ বিবেচনায় আবার নিয়মিত বিনিয়োগ দেখানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ মোট বিনিয়োগের প্রায় ২০ শতাংশ।

অনেক ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন ভাল দেখানোর জন্য খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখায়। দীর্ঘদিনের খেলাপি ঋণগুলো ব্যালান্সশীট থেকে মুছে ফেলা হয়। এটাকে ঋণ অবলোপন বলা হয়। এ ধরণের ঋণ আদায়ের আশা খুবই কম। ২০২২ সালের শেষে ব্যাংকগুলোর অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় এর পরিমাণ বেড়েছে ৮ শতাংশেরও বেশি। এভাবে জনগণের সম্পদ খেলাপিদের পেটে হজম হয়ে যাচ্ছে।
এক লোক ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে গিয়ে কৌতুক করে বললেন ‘প্লিজ গিভ মি এ লোন অ্যান্ড লিভ মি অ্যালোন।’ অর্থাৎ লোন দেয়ার পরে আমার সাথে আর যোগাযোগ না রাখলেই ভাল হয়। খেলাপি গ্রাহকদের মনের অবস্থাও এমনই প্রতীয়মান হয়। ব্যাংকাররা খেলাপি বিনিয়োগ আদায় করতে গেলে তারা দেখা দিতে চান না। অনেকে দেখা দিলেও তেলে বেগুনে জলে ওঠেন ব্যাংকারদের ওপর। নানান বাহানা তৈরি করেন ব্যাংকের বিনিয়োগ পরিশোধ করতে চান না।

এসব গ্রাহকদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে ব্যাংক সম্পত্তি নিলামে তুলে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে চাইলেও তারা প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকারদের বিরত রাখার চেষ্টা করেন। অনেক সময় কোন কোন গ্রাহক মিথ্যা গল্প ফেঁদে মিডিয়ায় ব্যাংককে জনগনের কাছে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ ব্যাংকের মর্টগেজ করা সম্পত্তি নকল কাগজ পত্র তৈরি করে গোপনে বিক্রি করে দেন। এতে বেকায়দায় পড়ে ব্যাংক।

বাংক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি এক ওয়েবিনারে অর্থনীতিবিদগণ এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “যেকোন দেশের আর্থিক খাতের নীতি পেশাগতভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে আর্থিক খাতে রাজনীতি ঢুকে গেছে। নতুন ব্যাংক তৈরি ও ঋণ প্রদান থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা হয়। এটা আমাদের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।”

পিডব্লিউসি-এর ব্যবস্থাপনা অংশীদার মামুন রশীদ বলেন “রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রভাবিত করে ফেলেছে। যেটা ২০০৭-০৮ সালের ক্রান্তিলগ্নেও দেখা যায়নি।”

ব্যাংকগুলো থেকে বিনিয়োগ নিয়ে সেটা কোন খাতে ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এসব খেলাপির অনেকেই ব্যাংকগুলো থেকে বিনিয়োগ নিয়ে তা বিদেশে পাচার করছে। ফলে দেশের প্রকৃত সম্পদ কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে দ্রব্যমূল্য। বাজার মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাধারণ মানুষের আয় সমানভাবে বাড়ছে না। ফলে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ খেলাপি গ্রাহক ও পাচারকারীদের কর্মকান্ডের পরিণাম সমগ্র জাতি ভোগ করছে। অধঃ পতনের দিকে যাচ্ছে ব্যাংক ও অর্থনীতির চাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একক ঋণগ্রহীতার সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, যেন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে কোন ব্যাংক জিম্মি হয়ে না পড়ে। এই সীমা মেনে ঋণ দেয়া হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তব্য। ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু কয়েকটি ব্যাংক এই সীমা অতিক্রম করে ঋণ প্রদান করে ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলছে।

একটি প্রচলিত কৌতুক রয়েছে ‘তুমি যদি পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ নাও তাহলে সেটা পরিশোধের জন্য মাথা ব্যাথা তোমার। তোমাকেই ব্যাংকের পিছনে ছুটতে হবে। আর যদি পাঁচশ কোটি টাকা নাও তাহলে মাথা ব্যাথা ব্যাংকের। ব্যাংক তোমার পিছনে ছুটবে। তাই বড় বিনিয়োগ নাও।’

বড় বড় গ্রাহকদের অনেককেই দেখা যায় খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেশি। ব্যাংকগুলোকে তাই বড় বিনিয়োগ দেয়ার সময় গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা এবং সদিচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। বড় গ্রাহকদের খেলাপি বিনিয়োগের পরিমাণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে খেলাপি বিনিয়োগের ৫১ শতাংশই রয়েছে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে, যার পরিমাণ ৬৬ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বড় ঋণ কমিয়ে এসএমই এবং কৃষি ঋণ বেশি হারে বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকের টাকা জনগণের আমানত। সেটা সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা এবং যথাসময়ে ফিরিয়ে দেয়া ব্যাংকারের দায়িত্ব। আবার গৃহীত বিনিয়োগ সময়মত পরিশোধ করা বিনিয়োগ গ্রাহকের দায়িত্ব। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

ইসলামী শরীআহ ঋণ পরিশোধের বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করেছে। শহীদদের মর্যাদা পরকালীন জীবনে অনেক বেশি হবে। হাদীসে বলা হয়েছে শহীদদের সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে, কিন্তু ঋণের গুনাহ ক্ষমা করা হবেনা। এটি বান্দার হক । ব্যক্তি ক্ষমা না করলে মাফ হবে না। ব্যাংকের টাকা সাধারণ মানুষের। কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ শেষ বিচারের দিন থাকবেনা। তাই পরকালের শাস্তি থেকে বাঁচতে জীবিতাবস্থায় মানুষের হক ফেরত দেয়া প্রতিটি মুসলিম বিনিয়োগ গ্রাহকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

বাংলাদেশের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অপরিসীম। ব্যাংক খাতের ক্ষত খেলাপি সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে এ খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। এর পরিশোধনের কাজ শুরু করতে হবে এখনই। সমস্যার যায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের জন্য সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে। খেলাপি গ্রাহকদের সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দিতে হবে, এবং খেলাপি বিনিয়োগ আদায়ে ব্যংকগুলোকে সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের জন্য এখন একটি দৃষ্টান্ত। এত অল্প সময়ে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া দেশটি কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে! শ্রীলঙ্কা তাদের সংকট কাটিয়ে বাংলাদেশের ঋণও পরিশোধ করেছে। পেশাদারিত্ব সুশাসন ও মূল্যবোধের কারণে শ্রীলঙ্কা তাদের সংকট কাটিয়ে উঠছে।

শিল্প বিপ্লবের সুফল কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির মেরুদন্ড খ্যাত ব্যাংক খাতকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে যথাযথ নিয়মাচার পরিপালন করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া জরুরি। পাশাপাশি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনের নীতি গ্রহণ ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বাংক খাতের খেলাপি কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ খাতের সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধানের জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করত এ খাতকে গতিময় করার মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্যাংকার ও গ্রাহক সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক: রিয়াজ উদ্দিন, ব্যাংকার।

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বাণিজ্যিক বিবেচনায়  ‘সৌরবিদ্যুৎ’ টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক
কক্সবাজার: বাংলাদেশে অফুরন্ত পর্যটন সুযোগ উন্মোচন
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
ওএসডি কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে
নেট দুনিয়ার ব্যাংকিং
সর্বজনীন কল্যাণে ইসলামী ব্যাংক: আন্তরিক সেবার ৪০ বছর
সুইডেনের ইনফ্লেশন ১২ শতাংশ, গোল ২ শতাংশ
ব্যাংকের নাম: লিমিটেড থেকে পিএলসি