কার্ডবিহীন লেনদেনের অবারিত সুযোগ ব্যাংকিং খাতকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। এসব সুবিধার ফলে ব্যাংকিং সেবা গ্রাহকের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। সুতরাং এখন বলাই যায় ব্যাংকের গ্রাহক নয়, সেবাই গ্রাহকমুখী। এমনকি সত্যিই গ্রাহকের হাতের ডগায় ব্যাংকিং সেবা চলে যাওয়ার ফলে বর্তমানে ব্যাংকের আঙিনায় আনাগোনা কমেছে।
মধ্যযুগে রেনেসাঁর একদম শুরুর দিকে ইতালির বিভিন্ন ধনী শহরগুলোতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সূচনা ঘটে। ইংরেজি “ব্যাংক” শব্দটি নেওয়া হয়েছে ফরাসি শব্দ “ব্যাংকু” থেকে, যেটি এসেছে মূলত রোমান শব্দ “ব্যাংকা” থেকে, যার অর্থ টেবিল। এই ব্যাংকা শব্দটির উদ্ভূত আবার প্রাচীন জার্মান ব্যাংক থেকে, যার মানে বেঞ্চ বা কাউন্টার। রেনেসাঁর সময়ে ফ্লোরেনটাইন ব্যাংকারদের বেঞ্চগুলো অস্থায়ী ডেস্ক বা বিনিময় কাউন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
বর্তমান তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্বে এই প্রেক্ষাপট পরিপূর্ণরুপে পরিবর্তন হয়ে গেছে। নেটিজেনদের কাছে এখন ব্যাংকিং মানে কলমের খোঁচা নয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘরে বসেই ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণ করা। ১৪ শতকের দিকে ফ্লোরেন্স জুড়ে ব্যাঙ্কিংয়ের আধিপত্য বিস্তার করে বার্দি এবং পেরুজি নামক রাজকীয় পরিবার দুটি। পরবর্তীতে ইউরোপের অন্যান্য জায়গাগুলোতেও তাদের একাধিক শাখা স্থাপিত হতে থাকে। এ সময় ব্যাপক হারে জনসাধারণকে ঋণ দেওয়া এবং তাদের কাছ থেকে আমানত গ্রহণের কার্যক্রমগুলো ঘটতে থাকে। অবশ্য রোমান সাম্রাজ্য পতনের মধ্যে দিয়ে পুরো ব্যবস্থাটিই ধ্বংস হয়ে যায়। প্রায় ১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে চীনের ঝাউ রাজবংশের শাসনামলে ব্রোঞ্জের তৈরি মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। এর আগে কাউরি বা ঝিনুকের খোল দিয়ে মুদ্রা বানানো হতো। এগুলো প্রকৃতিতে খুব সহজলভ্য ছিল বিধায় বিকল্প হিসেবে ব্রোঞ্জে খোদাই করা মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার লিডিয়া রাজ্যে উদ্ভাবিত হয়েছিল ডিস্ক-আকৃতির, স্বর্ণ, রৌপ্য বা ব্রোঞ্জ নির্মিত মুদ্রা। নকল থেকে আসল মুদ্রা আলাদা করতে এগুলোর উভয় পাশে খোদাই করা হতো দেবতাদের বা সে সময়কার রাজাদের প্রতিকৃতি। পরবর্তী শতাব্দীতে এগুলো গ্রিস অব্দি ছড়িয়ে পড়েছে। এই মুদ্রা থেকেই বর্তমান সময়ের সমস্ত আধুনিক মুদ্রা এসেছে। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যাপকতা লাভ করে ৬৫০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। এ সময় খোদাইকৃত মুদ্রা দিয়ে সেনাবাহিনীর পারিশ্রমিক দেয়া হতো। মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণ প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আধুনিক তুরস্কের প্রাচীন রাজ্য লিডিয়ায়। ইলেক্ট্রাম নামে পরিচিত রূপা ও সোনার একটি সংকর ধাতু ব্যবহার করা হতো মুদ্রাটি তৈরি করতে। সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে প্রতিটি গ্রাহককে সন্তুষ্ট করতে এবং গ্রাহকদের আকর্ষণ ধরে রাখার মূলমন্ত্র হিসেবে উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ব্যাংকিং সেবা পৃথিবীকে উন্নত করেছে। আর গ্রাহকের চাহিদার জন্য অনলাইনের মাধ্যমে আদান-প্রদান বা ই-ব্যাংকিংয়ের দ্রুত বিকাশ ঘটিয়েছে।
উন্নত দেশের মতো আমাদের ব্যাংকগুলোও শাখা-সংক্রান্ত বাধা তুলে দিয়ে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে ডিজিটাল রূপান্তরের সঙ্গে গ্রাহকদের অভ্যস্ত করা হচ্ছে। আর ব্যাংকিং খাতকে আরও নিরাপদ, সহজ ও গ্রাহকবান্ধব করতে ডিজিটাল ব্যাংকিং গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে প্রযুক্তির নতুন বন্ধনের সংযোগ সৃষ্টি করেছে। আর এ ডিজিটাল বন্ধনেই হবে আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলার অন্যতম শক্তি।
লেখক: ব্যাংকার
অর্থসংবাদ/এসএম