অনেক ঘোরাঘুরি করে ঢাকার অদূরে মাতুয়াইলে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে টিনসেডসহ ২ কাঠা জমি কিনতে সক্ষম হন। জমি কেনার পর নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হন। প্রথমতঃ জমি কিনতে জমানো সব টাকা শেষ। ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ ও সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে টাকা জমানো কঠিন। এ অবস্থায় চলতে থাকলে সারা জীবনেও বাড়ি করা সম্ভব হবে না। টিনসেড বাড়িতেই থাকতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ জমিটি একটি স্টিল মিলের পাশেই। সারাদিন মিলের শব্দ আবাসিকতার পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। বড় ধরণের অসুবিধায় পড়ে যান তিনি। সুযোগ খুঁজতে থাকেন ভাল কিছু করার। একই অবস্থা তার অনেক সহকর্মীর। তাদের সাথে পরামর্শ করেন কিভাবে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সমমনা ২৫ জন মিলে রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে ৯ কাঠা জমি ঠিক করেন ২ কোটি ৫০ লাখ টাকায়। সে হিসেবে প্রত্যেকের ভাগে জমির জন্য ১০ লাখ টাকা লাগবে। মোশারেফ তার মাতুয়াইলের জমিটি দুই লাখ টাকা লাভে স্টিল মিল কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে দেন এবং সহকর্মীদের সাথে যাত্রাবাড়ির জমির একটি শেয়ার কিনে নেন। ২০১৮ সালে দশ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। নিজেরা নির্মান কাজ তদারকি করে তিন বছরে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেন। প্রতি ফ্লোরে ৪টি করে মোট ৩৬ টি ফ্ল্যাট। কেউ ১টি কেউ ২টি ফ্ল্যাটের শেয়ার নিয়েছে। নির্মাণ কাজে শেয়ার প্রতি ব্যয় হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের মালিক হতে পেরেছেন তিনি। সহকর্মীদের সাথে সুন্দর পরিবেশে পরিবার নিয়ে সেখানেই বসবাস করছেন।
মোশারেফের মত অনেকেই এখন যৌথ উদ্যোগে বাড়ি নির্মাণের দিকে ঝুঁকছেন। ডেভেলপার কোম্পানীগুলোর অধিক মুনাফা ও নানাবিধ ফাঁকির জাল থেকে মুক্তির জন্য বেশিরভাগ মানুষ এ পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন। ঢাকাসহ দেশের অনেক শহরে এ ধরণের অনেক উদ্যোগ চোখে পড়ে। যৌথভাবে বাড়ি নির্মাণ করেছেন এমন অনেকের সাথে কথা বলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
বাড়ি নির্মানের জন্য জমি নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অভিজ্ঞরা মনে করেন প্রশস্ত রাস্তার পাশের জমি বাড়ি করার জন্য ভাল। ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে বাড়ির সকল দলিল, মিউটেশন ও খাজনা পরিশোধের সর্বশেষ রসিদ ব্যাংকে জমা দিতে হয়। অনেক জমি রয়েছে যেগুলোর কাগজপত্র ও মালিকানায় ত্রæটি রয়েছে। ত্রæটিযুক্ত জমি ক্রয়ে ব্যাংকের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না। ত্রুটিপূর্ণ জমি ক্রয় করলে ভোগান্তিতে পড়বেন ও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই জমি ক্রয়ের আগেই জমির মালিকানা সঠিক কিনা তা ভ‚মি অফিস ও আবাসন প্রকল্পের অফিসে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হতে হবে। এছাড়া অভিজ্ঞ আইনজীবির লিখিত মতামত গ্রহণ করতে হবে।
অভিজ্ঞ আর্কিটেক্ট দিয়ে ভবনের চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করে কাজ শুরু করা উত্তম। অনেক আর্কিটেক্ট রয়েছেন যারা কম খরচে কাজ করে দিতে সম্মত হন কিন্তু তারা ত্রুটিপূর্ণ নকশা দিয়ে গ্রহককে প্রতারিত করেন। তাই অভিজ্ঞ আর্কিটেক্ট দিয়ে ভবনের পূর্ণাঙ্গ নকশা প্রস্তুত করে নিজেদের পছন্দ ও প্রয়োজনের সাথে মিলিয়ে সেগুলো সংশোধন করে নিতে হবে। ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা রেখে নকশা করলে পরবর্তীতে বিদ্যুৎ খরচ কম হবে।
নির্মাণ কাজের খরচ সীমার মধ্যে রাখতে সকল প্রকার নির্মাণ সামগ্রী নিজেরা উপস্থিত থেকে ক্রয় করতে হবে। এজন্য অংশীদারদের মধ্য থেকে যারা সময় দিতে পারবেন তাদের কয়েকজনকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। ব্যয়ের সাথে জড়িত সবাইকে শতভাগ সততার নীতি অবলম্বন এবং স্বচ্ছতার জন্য সকল লেনদেনের রসিদ সংগ্রহে রাখা ও যথাযথ লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের জন্য কিছু সম্মানির ব্যবস্থা থাকলে কাজে উৎসাহ পাবেন। নির্মান কাজে যিনি নেতৃত্ব দিবেন তাকে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কাজের বিনিময়ে নির্ধারিত সুবিধার অতিরিক্ত পাওয়ার আশা করলে সেটা কষ্টের কারণ হতে পারে। অন্যান্য সদস্যদের রুচি ও পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। সদস্যরাও কাজে যথাসাধ্য সহযোগিতা করবেন এবং নিয়মিত পর্যালোচনা বৈঠকে পরামর্শ দিবেন।
নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই আলোচনা করে ফ্ল্যাটের মালিকানা নির্ধারণ করে নেয়া ভাল। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হলে লটারির মাধ্যমে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করা যায়। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। পছন্দসই ফ্লোরে সবার ফ্ল্যাট নাও হতে পারে। লটারির মাধ্যমে নির্ধারিত সমন্বিত সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। তুলনামূলক অসুবিধাজনক ফ্লাটের মালিকদের জন্য কিছু ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের তালিকা তৈরি করে কাজ করলে পরিস্থিতি মোকাবেলা সহজ হয়। যেমন জরুরি কাজগুলো আগে এবং সৌন্দর্যবর্ধনমূলক কার্যক্রম অর্থের সংকুলান অনুযায়ী করা উত্তম।
নির্বাচিত সদস্যরা নিয়মিত নির্মাণ কাজ তদারকি করবেন। ডিজাইন অনুযায়ি যথাযথ কাজ হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করবেন এবং ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। অন্যান্য সদস্যরাও নিয়মিত খোঁজখবর নিবেন এবং নিয়মিত বিরতিতে কাজের পর্যালোচনা করবেন।
পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ যৌথ উদ্যোগের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে নকশায় পরিবর্তন বা বড় কোন কাজ করা যাবে না। এক্ষেত্রে ত্রæটি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সবার পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি। ভুল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে সবাই ক্ষতির সম্মুখিন হবে অনেক ক্ষেত্রে যার কোন সমাধান নেই। এতে পারস্পরিক সম্পর্কে ফাটল ধরার সম্ভাবনা থাকে।
কমন ডিজাইনের জন্য সবার পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ব্যক্তিগত ফ্ল্যাটের অভ্যন্তরীন সাজসজ্জা, টাইলস ও ফিটিংয়ের ক্ষেত্রে নিজস্ব পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব দিতে হবে। ভাল কোম্পানীর নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করতে হবে। ভাল মানের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভবনের লিফট, জেনারেটর ও সাবস্টেশন স্থাপন ও পরবর্তী সার্ভিসিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেসব এলাকায় গ্যাস সংযোগ নেই সেখানে ভবনের নির্দিষ্ট স্থানে সেন্ট্রাল লাইন ও সাব মিটার স্থাপন গ্যাস সরবরাহ সহজ হবে। গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে এ ব্যবস্থা করা যায়।
যৌথ বিনিয়োগে কাজের ক্ষেত্রে নানাবিধ বাধা ও প্রতিক‚লতা আসতে পারে। বৈরি সময়ে গ্রæপের সদস্যদের সমস্যার ধরণ পর্যালোচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দুঃসময়ে নিজেদের বন্ধনকে আরো মজবুত করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। সকল বৈরি পরিস্থিতি ধৈর্যের সাথে সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ত্যাগের মাধ্যমে বড় বড় অর্জন সহজ হয়। দলবদ্ধ ভাবে কাজ করলে অনেক বড় কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব যা একার পক্ষে সম্ভব নয়। ইংরেজি প্রবাদে যেমনটি বলা হয়েছে ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড ডিভাইডেড উই ফল’ অর্থাৎ একতায় উত্থান বিভেদে পতন অথবা দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ।
বিশ্বের বড় বড় কোম্পনীর বেশিরভাগ যৌথ উদ্যোগেরই ফসল। বিশ্ব সেরা সফল যৌথ উদ্যোক্তা পল এলেন ও বিল গেটস। তারা যৌথভাবে মাইক্রোসফটের যাত্রা শুরু করেছিলেন একটি নড়বড়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তাদের প্রচেষ্টায় বর্তমানে মাইক্রোসফটের বাজারমূল্য ৫০ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। বিল গেটস বলেন “সাফল্যের একটি মূল উপাদান হল ধৈর্য্য”। সফলতার জন্য ধৈর্য্য সহকারে চেষ্টা করে যেতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে নেমে পড়ুন আর তাড়াহুড়ো না করে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিন। আশা করা যায় সাফল্য ধরা দিবে।
লেখক: রিয়াজ উদ্দিন, ব্যাংকার