গত বুধবার এক সার্বভৌম ঋণের বিপরীতে প্রায় আট কোটি ডলার কিস্তি পরিশোধ করার কথা ছিল শ্রীলঙ্কার। বস্তুত বুধবার এই কিস্তির ৩০ দিনের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, তাঁরা এখন ঋণখেলাপির কাতারে। তিনি আরও বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার, সার্বভৌম ঋণদাতারা আমাদের ঋণ পুনর্গঠন না করলে আমাদের পক্ষে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। সে জন্যই আমরা বলছি, এটা প্রি-এম্পটিভ ডিফল্ট, অর্থাৎ একধরনের আত্মরক্ষামূলক ঋণখেলাপ।’
ঋণখেলাপি শ্রীলঙ্কার সর্বনাশের মূল কারণ, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় বন্ড বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নির্বিচারে বিক্রি করা। সোজা কথায়, শ্রীলঙ্কার সরকার দেদার ডলারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে।
এই ডলারভিত্তিক সঞ্চয়পত্র দেশটির সর্বমোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় অর্ধেক। রাষ্ট্রীয় রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ তলানিতে ঠেকার কারণে এই সঞ্চয়পত্রের কিস্তিভিত্তিক মুনাফার অর্থ দিতে শ্রীলঙ্কার সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
জরুরি আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলারের জন্য শ্রীলঙ্কার সরকার আইএমএফের কাছে হাত পাতছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে সঞ্চয়পত্রের সুদের টাকা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পরে শোধ করবে। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা প্রাথমিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় বিক্রি করা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে নেওয়া ঋণের পুনঃ তফসিলীকরণ করছে। এটা শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ।
বিশ্লেষকেরা বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেননি। অব্যবস্থাপনা তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল নীতিগত দুর্বলতা। রাসায়নিক সার ব্যবহারের ওপর আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা ও কর কমানোর মতো কিছু নীতি শ্রীলঙ্কার জন্য বিপর্যয় বয়ে আনে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে জনগণের ওপর। ফলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। পরবর্তী সময়ে যা সহিংসতায় রূপ নেয়।
এদিকে গত মাসে ফিচ রেটিংস ও এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংসের পূর্বাভাস ছিল, চূড়ান্ত আর্থিক সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক ঋণ শোধ করতে পারবে না। চলতি বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক ঋণ এবং সুদ মেটাতে অন্তত ৬৯০ কোটি ডলার ব্যয় করার কথা শ্রীলঙ্কার। অথচ দেশটির সরকারি তথ্য বলছে, বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় মাত্র ২৩১ কোটি ডলারে এসে ঠেকেছে।
ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কার ঋণমান হ্রাস পাবে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক যেসব সংস্থার বিভিন্ন দেশের ঋণযোগ্যতা নির্ধারণ করে, তাদের চোখে খাটো হবে শ্রীলঙ্কা। এটা যেকোনো দেশের জন্য অপমানজনক। এখন শ্রীলঙ্কার পক্ষে নতুন করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঋণ পাওয়া আরও কঠিন হবে। তবে ঋণ খেলাপের পর বিবিসির পক্ষ থেকে বিভিন্ন ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চায়নি।
এদিকে মাহিন্দা রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর রনিল বিক্রমাসিংহে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু তিনিও আশার কথা শোনাতে পারছেন না। অবশ্য পরিস্থিতি যে জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, তাতে রাতারাতি বড় পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এদিকে ক্ষমতা গ্রহণের পর গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারে রনিল বিক্রমাসিংহে বলেন, ‘পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আগে আরও একদফা অবনতি হবে বলে মনে হচ্ছে।’ তবে তাঁর অঙ্গীকার, শ্রীলঙ্কার মানুষের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা হবে। মানুষ অভুক্ত থাকবে না। যেখান থেকেই হোক, খাবারের জোগান নিশ্চিত করা হবে।