স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে কেউ কেউ তলাবিহীন ঝুঁড়ি বললেও এদেশের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা সেই অপবাদকে ভুল প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এদেশের ১ কোটির বেশি মানুষ কর্মরত রয়েছেন। আয় হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। করোনা মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যেও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করে।
সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বের তেল ও খাদ্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ডলারের রিজার্ভে টান পড়ে। ফলে গত দুই মাসে ডলারের রিজার্ভ ৪৮ বিলয়ন থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আইএমএফ এর হিসাবে সেটা ৩৫ বিলিয়ন ডলারেরও নীচে। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে দেশের রিজার্ভ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ। সেখান থেকে ১ বিলিয়নের ঘর ছুঁতে ১০ বছর সময় লাগে। ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে সেটা দাঁড়ায় ১.৬ বিলিয়ন। ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত রিজার্ভ ১৫ বিলিয়ন ডলার হয়। ২০২০ সালে করোনা মহামারির মধ্যে দেশের রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ বিলিয়ন এবং ২০২১ সালে ৪৮ বিলিয়ন ডলার। অতীতে কম রিজার্ভ নিয়েও উদ্বেগ ছিল না। সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ধ্বস আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ এক সময় অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও নানাবিধ ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেউলিয়াত্ব বরণ করে দেশটি।
ডলার সঙ্কট সৃষ্টির যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি, মানি লন্ডারিং এবং হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ প্রেরণ উল্লেখযোগ্য। এসব সমস্যা সমাধানে অর্থনীতিবিদগণ নানাবিধ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নানাবিধ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ ব্যাংকারদের বিদেশে প্রশিক্ষণ ও অফিসিয়াল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। বিলাসদ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নেয়া হয় নানা ধরণের পদক্ষেপ।
কলকারখানার যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, জ্বালানি তেল ও গ্যাসসহ অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলো আমদানির কোন বিকল্প আমাদের নেই। তবে খাদ্যদ্রব্য ও ভোজ্য তেলের উৎপাদন বাড়াতে পারলে সেক্ষেত্রে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কিছুটা কমানো সম্ভব। ধান, গম, ভুট্টা ও সরিষাসহ অন্যান্য তেলবীজ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়ালে আমরা খাদ্যে আমদানি নির্ভরতা অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবো। যেসব অনাবাদি জমি রয়েছে সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার এবং আবাদি জমিতে বারবার চাষ এবং উন্নত বীজ ও কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকেই।
বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দ্রুত ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব না হলে সেগুলো আমাদের জন্য মাথা ব্যাথার কারণ হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হলে এসব খাত থেকে আসা আয় দিয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সহজ হবে। অন্যথায় এসব প্রকল্পের জন্য নেয়া বৈদেশিক ঋণের কিস্তি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর বড় রকমের চাপ সৃষ্টি করবে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, বড় প্রকল্প গ্রহণের আগে সেগুলো থেকে আমাদের কি পরিমাণ রিটার্ণ আসবে সেদিকে খেয়াল রেখে প্রকল্প গ্রহণ করা উত্তম। অন্যথায় আমাদের ভোগান্তি বৃদ্ধির সম্ভাবনাই বেশি। দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে পারলে দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে সুবিধাজনক অবস্থা সৃষ্টি সহজ হবে।
দেশে প্রতিবছর প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক রেমিট্যান্স আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। আরো প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে অবৈধ চ্যানেলে বা হুন্ডির মাধ্যমে। নানাবিধ কারণে মানুষ হুন্ডি বেছে নেয়। ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের রেট কম থাকায় অনেকে হুন্ডিতে টাকা পাঠান বেশি পাওয়ার জন্য। এতে প্রবাসীদের স্বজন টাকা পেলেও দেশ বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। প্রবাসীদের সব আয় বৈধ চ্যানেলে দেশে আনা সম্ভব হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।
হুন্ডির কুফল প্রবাসীদের কাছে তুলে ধরে বিভিন্ন ব্যাংক কাজ করলেও সেটা ফলপ্রসু হচ্ছে না। এখনো বিপুল অঙ্কের হুন্ডি আসছে। হুন্ডি কমাতে সরকারের তরফ থেকে আরো জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার মনে করেন অনেকে। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন বা বাফেদা সম্প্রতি হুন্ডি কমাতে রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের জন্য সরকারের দেয়া প্রণোদনা ২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্ণর বরাবর আবেদন করেছে বলে জানা যায়।
প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নে বিভিন্ন ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোতে প্রতিনিধিরা কাজ করছেন। সেক্ষেত্রে প্রবাসীদের আকৃষ্ট করতে একেক ব্যাংক একেক রকম রেট দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন। কোন কোন ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া রেটের চেয়ে অনেক বেশি রেট দিয়ে প্রবাসীদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে। ব্যাংকগুলোর এ ধরণের আচরণে মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি ডলারের চাহিদা বেশি থাকায় অনেক ব্যাংকই ইচ্ছামত দরে ডলার বেচাকেনা করে। কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে ডলারের দাম ১০৪ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। বাফেদার ঐ আবেদনে এক রেটে সকল ব্যাংককে রেমিট্যান্স আনয়ন ও লেনদেন করার নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। কোন কোন মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন না থাকলেও তাদের দ্বারা প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আনার খবর পাওয়া যায়। এতেও প্রবাসী আয় হারাচ্ছে দেশ।
মানি লন্ডারিং আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ডকে ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে দিচ্ছে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি এর তথ্য মতে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব টাকা চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ ১০টি দেশে। আমদানি-রফতানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি আর হুন্ডির আড়ালে অর্থপাচার করছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০, ৫ বছরে পাচারকারীরা ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। পাচারকৃত টাকার পরিমাণ বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় পাচারকারী দেশ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ।
দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যাংকারসহ ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তাদের ক্ষমতা এবং প্রভাবের কারণে এই অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে প্রকাশিত খবরে বলা হয়। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং ও দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলে জ্বালানি, খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানীর ক্ষমতা কমে যাবে। কমে যাবে শিল্পোৎপাদন ও রপ্তানী। থেমে যাবে দেশের উন্নয়নের চাকা। বেড়ে যাবে দারিদ্র্য। বরণ করতে হতে পারে শোচনীয় ভাগ্য। দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের। তাই সাময়িক লাভের আশায় দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত না হয়ে দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রত্যেকের কর্তব্য। বিদেশে অর্থ পাচার করার পরিণতি কখনো শুভ হয় না। দিন শেষে অনেকেই পাচার করা অর্থ ভোগ করতে পারছেন না। শোচনীয় ভাগ্য বরণ করছেন অনেক প্রভাবশালী ও দুর্নীতিবাজরা।
বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি জনগণের দেশপ্রেম বাড়াতে হবে। নতুন নতুন শ্রম বাজার খুঁজে বের করা, তৈরি পোষাক, চামড়া ও চামড়া জাত পণ্য, কৃষি ও শিল্প পণ্য রপ্তানী বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে হবে। বন্ধ করতে হবে দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং, লোভ ও হুন্ডি। তাহলে আশা করা যায় আবারো ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।
রিয়াজ উদ্দিন : লেখক ও ব্যাংকার