তারা বলেন, এসব কার্যক্রম পরিচালনার মতো সিটি করপোরেশনের জনবল ও সক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশন যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তা নগরবাসীর মন ভোলানো বা কর্তৃপক্ষ দায় এড়ানোর জন্য করছে। এসব কার্যক্রম মিডিয়াতে ব্যাপাকভাবে প্রচার হচ্ছে। বাস্তবে এ ধরনের কার্যক্রম ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।
জানা যায়, এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে ৩ এপ্রিল তথ্যভিত্তিক চিত্র তুলে ধরেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ আশঙ্কার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ঢাকার দুই সিটি মেয়র। এরপর দুই মেয়র পৃথক কর্মসূচিতে নগরবাসীকে ডেঙ্গুর বংশবিস্তারের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, সিটি করপোরেশন সক্ষমতার আলোকে ডেঙ্গুপরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ বিষয়ে নগরবাসীকে সতর্ক হতে হবে। নইলে এবারও ডেঙ্গি আমাদের ভোগাতে পারে।
আরও জানা যায়, ২৫ মে পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৩ জন। যেটা এপ্রিলে ছিল ২৩ জন। মার্চ ও ফেব্রুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০ জন করে। চলতি মাসে বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ৪ শতাংশের বেশি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডে ২৫ মার্চ থেকে চলা এ জরিপের নবম দিনে এমন চিত্র মিলেছে বলে জানানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ২৫ মার্চ থেকে দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডে জরিপ পরিচালনা করে। ২১ জন কীটতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে গড়া দল এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর আওতায় মোট ৩১৫০টি বাড়িতে জরিপ চালানো হয়। এরমধ্যে ১১৪টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও কার্ভাড ড্রেন রয়েছে। যেগুলোতে দুই সিটি মশার ওষুধ ছিটাতে পারে না। পাশাপাশি প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী, পলিথিন, ডাবের খোসাসহ বিভিন্ন আবর্জনায় ওই ড্রেনগুলো ভরাট থাকে। দুই ভবনের মাঝখানের জায়গাগুলো আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যে কারণে ড্রেন দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয় না। জমাটবদ্ধ এসব পানিতে কিউলেক্স ভয়াবহরূপে বংশ বিস্তার করে। এসব স্থানে মশার প্রজনন ধ্বংস করতে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না। এছাড়াও জলাশয়, খাল, নর্দমা ও যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী ও ডাবের খোসার পানিতে ভয়াবহরূপে মশার বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে। মশক নিধনে দুই সিটির পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ৮৫ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা । যা মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে খরচ হচ্ছে। অথচ তার কোনো সুফল মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুতই বাড়ছে। এর প্রধান কারণ হলো, গত বছর ঢাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কাজ হয়নি। এবারও সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কাজের একই চিত্র। মিডিয়া আমন্ত্রণ জানিয়ে ফগিং করে, প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
কাজের কাজ কিছুই করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, যে প্রক্রিয়ায় মশক নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, সে অনুযায়ী করপোরেশন প্রস্তুতি নেই। সে ধরনের জনবল ও ইচ্ছা, কোনোটিই নেই সিটি করপোরেশনের। প্রয়োজন ছিল নিজস্ব কীটতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে ডেঙ্গু প্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে নিবিড়ভাবে সেগুলোয় বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করা। এ ধরনের কার্যক্রম সিটি করপোরেশন কখনো করে না। এছাড়া যেসব ওষুধ ছিটাচ্ছে, তাতে মশা মরছে না। একটা লুকোচুরি চলছে।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সামনের দিনগুলোতে এটা আরও বাড়তে থাকবে। ৫ থেকে ৭ বছর অন্তর চিকুনগুনিয়া ফিরে আসে। সে হিসাবে ২০১৭ সালে ঢাকায় চিকুনগুনিয়া হয়েছিল; তাই, এবার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনের কাজ করার কোনো আগ্রহ নেই। নিজেরা কোনো কাজ করে না; কিন্তু, উলটাপালটা কথা বলে। ডিএনসিসি প্রতি শনিবার বাসাবাড়ি পরিষ্কার করার কর্মসূচি গ্রহণ করলেও এখন তা সেভাবে কার্যকর নয়। অন্যদিকে ডিএসসিসি মেয়র বলছেন প্রতিদিন জমা পানি ফেলে দিতে। তাহলে মানুষ কি সারা দিন এ কাজই করবে। তাদের আর কোনো কাজ নেই। আমার পরামর্শ সিটি করপোরেশনের উচিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা এবং কার্যকর মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
এডিস মশার প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সম্পর্কিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ কার্যক্রম টিমে আমিও সদস্য ছিলাম। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে আমি এডিস মশার প্রজনন চিত্র পর্যালোচনা করে থাকি। সে অভিজ্ঞাত থেকে আমার কাছেও মনে হয়েছে, এবার ডেঙ্গির আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে। এটা প্রতিরোধে ব্যক্তিগত পর্যায়েও নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তাদের সেগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, এবার ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার আলোকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন এবার কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেয়েছে। কেননা, কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুমের দুই মাস আগ থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে নগরবাসীর সহযোগিতা প্রয়োজন। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সবকে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ডিএনসিসি এডিস মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এডিস মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধে নগরবাসীকেও এগিয়ে আসতে হবে।