অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে রকিবুর রহমান বলেন, “অর্থমন্ত্রী আপনি সরকারিভাবে একটি অ্যাসেট মানেজমেন্ট কোম্পানি করে সেই কোম্পানির মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তা পরে বাজারে বিক্রি করে টাকা আদায়ের যে পরিকল্পনা করেছেন আমি মনে করি তা সফল হবার নয়। বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদের প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে যাবে।
তাতে করে এই সুযোগে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা ঋণ পরিশোধ না করার আরও সুযোগ পেয়ে যাবে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা যে জমি বন্ধক রেখেছে, মনে করেন যার বাজার মূল্য পাঁচ কোটি টাকা সেটা তারা দেখিয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। এর সাথে তারা যে পার্সোনাল গ্যারান্টি দিয়েছে বা কর্পোরেট গ্যারান্টি দিয়েছে তার কোনো মূল্য নাই। তাদের বন্ধকের জমি বিক্রি করতে গেলে ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রে দেখবেন এই জমিগুলো আরও অনেক জায়গায় বন্ধক দেয়া আছে”— বলেন ডিএসইর সাবেক এই সভাপতি।
তিনি বলেন, “অর্থমন্ত্রী, মহান পার্লামেন্টে আপনি বলেছেন, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকের যোগসাজশে এবং তাদের অনুগত ব্যাংকের এমডি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহায়তায় তারা গ্রাহকের টাকা নিজের নামে, বেনামে বা আত্মীয়স্বজনের নামে আত্মসাৎ করে বিদেশে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছে, বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। কানাডা, দুবাই, সিঙ্গাপুরে তারা বিশাল সম্পদ গড়ে তুলেছে।
ব্যাংক পরিচালকরা যারা ইচ্ছাকৃতভাবে টাকা ফেরত দিচ্ছে না তাদের ব্যাংকের পরিচালক থাকার অধিকার নাই। এদের খুঁজে বের করতে হবে। ব্যাংকের প্রকৃত মালিক হলো হাজার হাজার শেয়ারহোল্ডার, তাদের স্বার্থ আপনাকে দেখতে হবে। ব্যাংক পরিচালকদের সর্বোচ্চ শেয়ার সংখ্যা হলো মাত্র ৩০ শতাংশ, ক্ষেত্রে বিশেষ ৩৫ শতাংশ। কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগকারী যারা তারা ৭০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করে। এদেরকে ছেড়ে দেয়া যায় না”— বলেন রকিবুর রহমান।
অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, “আপনাকে কঠোর হতে হবে। আপনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার বিশেষ স্নেহভাজন ও অনুগত একজন ব্যক্তি। তিনি আপনার ওপর আস্থা রেখেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে সফলতার সাথে ঋণ আদায় করেছে। দেউলিয়া আইন কঠোর প্রয়োগ বলতে বোঝায়, যারা ইচ্ছেকৃতভাবে জনগণের টাকা লুটপাট করেছে তাদের লাইফস্টাইলে হাত দিতে হবে। যেমন- চিনে যারা দেউলিয়া আইনের আওতায় পড়েছে তাদের গাড়ি-বাড়ি থাকবে না, তাদের সন্তানরা দামি স্কুলে পড়ালেখা করতে পারবেনা, প্লেনে চড়তে পারবে না, এমনকি বুলেট ট্রেনেও চড়তে পারবে না। এই আইনের কঠোর প্রয়োগের ফলে তিন বছরের মধ্যে ৮০ পার্সেন্ট ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে মালয়েশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন সরকারও দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে টাকা আদায়ে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে ভারতের অর্থমন্ত্রী নিরমলা সিতারাম গত ১ বছর আগে একই পদ্ধতিতে দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং শুরু করেছেন। তাতে তিনি বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছেন এবং প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার ওপর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের থেকে টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ কেউই নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে চায় না’— বলেন ডিএসইর এই পরিচালক।
অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “আপনি যখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আপনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সকল ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের প্রতি ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে একটি বড় ধরনের রিসিডিউল করে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখলাম, মাত্র অল্প সংখ্যক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ডাউন পেমেন্ট দিয়ে তাদের খেলাপি ঋণ রিসিডিউল করেছে। ইন্টারেস্টিং হলো তারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো রি-অর্গানাইজড করে চালু করার জন্য ব্যাংকের কাছে টাকা চেয়েছে।
আমার প্রশ্ন যে সকল প্রতিষ্ঠান বছরের-পর-বছর বন্ধ হয়ে আছে তারা যে সকল পণ্য উৎপাদন করত অথবা ব্যবসা করত তাদের পক্ষে কি এখন সম্ভব নতুন করে ইন্ডাস্ট্রি চালু করে বর্তমানে যারা ব্যবসা করে অনেক এগিয়ে আছে তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা? যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ছিল তাদের কোনো পরিকল্পনা ছিল না, তাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, তাদের কোনো অনেস্টি ছিল না। ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিংয়ের সুযোগ নিয়ে, নিজস্ব ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের সহযোগিতায় এবং বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকগুলোর সরকার মনোনিত পরিচালক এবং ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় তারা ব্যাংক এবং জনগণের অর্থ লুটপাট করেছে।
এরা জেলে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু টাকা ফেরত দেয়ার ইচ্ছা এদের একেবারেই নেই। অতএব এদের বিরুদ্ধে বাস্তবসম্মত আইন প্রয়োগ করে টাকা আদায়ের অনুরোধ করছি। অপরদিকে যেসব শিল্পপতিরা বিশেষ করে যাদের পুঁজিবাজারে লিস্টেড কোম্পানি আছে, ওই কোম্পানিগুলোতে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে এবং সেই কোম্পানিগুলোতে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করেছেন, ওই প্রতিষ্ঠানের শিল্পউদ্যোক্তারা উচ্চ সুদের কারণে অথবা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে যদি ঋণখেলাপিী হয়ে পড়েন, তাদের প্রতি আপনাকে সদয় হতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “কীভাবে তাদের সহযোগিতা করা যায়, তাদের ইন্ডাস্ট্রি চালিয়ে রাখা যায়, সে ব্যাপারে আপনাকেই (অর্থমন্ত্রী) সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ না হয়ে যায় সে ব্যবস্থাও আপনাকে নিতে হবে। কোনো শ্রমিক যাতে চাকরি না হারায়, কোনো বিনিয়োগকারী যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকটা দেখে অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। দেশ এবং জাতি আপনার দিকে তাকিয়ে আছে।
করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত। সকল শিল্পপতি তাদের ইন্ডাস্ট্রি একপ্রকার বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে উৎপাদনও বন্ধ। এ সকল উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি যারা সব সময় ব্যাংকের টাকা সময়মতো পরিশোধ করেছেন, তাদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সকল সফল শিল্পপতি ও তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন না তারা যদি এই সুযোগে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকের টাকা পেয়ে যান তাহলে এটা হবে জাতির জন্য দুর্ভাগ্য।
যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন নাই তারা যেন প্রধানমন্ত্রীর এই অর্থ সহযোগিতা না পায় সে দিকে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, কারও প্রতি অনুরাগ-বিরাগ না হয়ে কঠোরভাবে দেউলিয়া আইন প্রয়োগ করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের লাইফস্টাইলে হাত দিয়ে টাকা আদায় করতে সক্ষম হবেন” – অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন রকিবুর রহমান।