পদ্মা নদীতে পারাপারের প্রধান বাহন ছিল ফেরী এবং লঞ্চ। স্পীড বোট এবং ট্রলারও ছিল। পদ্মা নদী পার হতে গিয়ে লঞ্চডুবি, ট্রলারডুবি এবং স্পীড বোট দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে অনেক। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসব পার্বণে পারাপারের ভোগান্তি ছিল সীমাহীন। ঘন্টার পর ঘন্টা ফেরিঘাটে আটকে থাকতো গাড়ি। প্রতিকূল আবহাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে এসব যানবাহনে পারাপার হতো লাখো মানুষ। বড় ছুটির সময় ফেরিঘাটে গাড়ির লাইন পড়ে যেত কয়েক কিলোমিটার। রোদ-বৃষ্টি-শীত-গ্রীষ্মের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তল্পিতল্পা মাথায় নিয়ে নদীর ঘাটে ছুটে চলেছে সকল বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশুরা। কত স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে এই নদীর ঘাটে! প্রিয়জনের সাথে মিলনের স্বপ্নের জাল বুনে প্রহর গুণেছে কত কর্মজীবী! অগণিত কর্মঘন্টা নষ্ট হয়েছে নদীর পাড়ে পারাপারের অপেক্ষায়।
খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষি পণ্য পরিবহণে প্রধান সমস্যা ছিল পদ্মা নদী পারাপার। শাক-সবজি, ফল, মাছ-মাংসসহ অন্যান্য পণ্য বোঝাই গাড়ি ফেরি ঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতো। ক্ষেত্র বিশেষে এক থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত সময় লাগত। ফেরি ঘাটেই পঁচে নষ্ট হয়েছে অনেক ব্যবসায়ী ও কৃষকের মূলধন।
পদ্মা সেতু এক সময় স্বপ্ন থাকলেও বর্তমানে তা বাস্তবতা। নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১২ সালে শুরু হওয়া পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবছর। ২৫ জুন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় দক্ষিণাঞ্চলের দরজা খ্যাত এ সেতু। এটি বাংলাদেশের উন্নয়নের মুকুটে আরেকটি নতুন পালক যোগ করলো। সেতু চালুর ফলে মাত্র কয়েক মিনিটেই পার হওয়া যাচ্ছে দীর্ঘতম এই নদী। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলার সাথে রাজধানীসহ সারা দেশের যোগাযোগের বিপ্লব সাধিত হবে এর মাধ্যমে। রাজধানীর সাথে এসব জেলার সড়ক পথের দূরত্ব কমে যাবে বহুগুণ। গতিশীলতা আসবে মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসহ এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যে।
রাজধানী ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে রাজধানী থেকে দক্ষিণ বঙ্গে যাওয়ার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটি অর্জন। তবে ভাঙ্গা থেকে খুলনা, বরিশাল এবং ফরিদপুর হয়ে অন্যান্য জেলায় যাতায়াতের রাস্তা এক লেনের হওয়ায় এসব পথে নতুন গাড়ীর রুট চালু করা ঝুঁকিপূর্ণ। বিদ্যমান সড়কে একাধিক রুটের গাড়ি চলাচল শুরু হলে সড়কে যানজট সৃষ্টি, দুর্ঘটনা বৃদ্ধি এবং ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত গাড়ী চলাচলের ফলে সড়ক বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অঞ্চলের সড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করা ও টেকসই করে গড়ে তোলা সম্ভব হলে এসব অঞ্চলের যোগাযোগে বিপ্লব সাধিত হবে।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি রেল যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহণ সহজ করতে দ্রুততম সময়ে এই রেল সংযোগ মংলা বন্দর এবং খুলনা পর্যন্ত বিস্তৃত করা জরুরি। বিদেশী বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। খুলনা-মংলা মহাসড়কের পাশে দীর্ঘদিন থেকে বিমানবন্দরের জন্য যায়গা অধিগ্রহণ করে রাখলেও তা নির্মাণ কাজের তেমন কোন অগ্রগতি নেই। এই বিমানবন্দরটি চালু হলে এ অঞ্চলের যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
পদ্মা সেতুর কাঙ্খিত সুফল পেতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বিনিয়োগসংক্রান্ত নীতি সংস্কার ও জোরদার করতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। পদ্মার ওপারে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প, মৎস্য, চামড়া শিল্প, পাট, গার্মেন্টস শিল্প, তথ্য-প্রযুক্তি, অটোমোবাইল এবং ইলেক্ট্রনিকসহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে দেশীয় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে এ অঞ্চলে সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পদ্মা সেতু চালুর ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। দেশের জিডিপি ১.৫ শতাংশ বেড়ে যাবে এবং দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২.৩ শতাংশ। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলে ব্যাংকের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড তুলনামুলক অনেক কম। পদ্মা সেতু চালুর ফলে উদ্যোক্তা ও ব্যাংকার উভয়ের জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অঞ্চলভিত্তিক বিনিয়োগের ভারসাম্য আনার অসীম সুযোগ তৈরি হয়েছে। সম্ভাবনাময় শিল্পগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এ অ লের অর্থনীতিকে আরো গতিশীল করার জন্য কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ ইকনোমিক জোন অথরিটি দক্ষিণ পশ্চিমা অঞ্চলের উন্নয়নে ১৭ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে মোংলায় ২টি ইকনোমিক জোন, সুন্দরবনের নিকট বাগেরহাটে একটি ইকোটুরিজম পার্ক, শরিয়তপুরের জাজিরা ও গোসাইরহাট, মাদারিপুরের রাজৈর, ফরিদপুর সদর, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া, খুলনার বটিয়াঘাটা ও তেরখাদা, মাগুরার শ্রীপুর, সাতক্ষীরা সদর, বরিশালের আগৈলঝাড়া ও হিজলা, ভোলা সদর ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করেছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা বাস্তবায়ন হলে সৃষ্টি হবে বিপুল কর্মসংস্থান। দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরণের পরিবর্তন আসবে এবং ২০৪১ সালের কাঙ্খিত উন্নত বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে।
নতুন সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে আমাদের গাড়ী চালকদের জন্য অনেকটাই নতুন পরিবেশ। উন্নত রাস্তা পেয়ে হঠাৎ করে দ্রুত গতিতে চলতে গিয়ে ঘটছে নানান দুর্ঘটনা। ইতোমধ্যেই সেতু এবং এক্সপ্রেসওয়েতে বেশকিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালানোয় উদ্বুদ্ধ করতে সেতু
কর্তৃপক্ষ ও সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেতু এবং এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায় সহজ করতে গ্রহণ করতে হবে উন্নত ব্যবস্থা যাতে দ্রুততম সময়ে গাড়ি টোলপ্লাজা অতিক্রম করতে পারে। পাশাপাশি টোলের পরিমাণ কমিয়ে গাড়িভাড়া সহনীয় পর্যায়ে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন মনে করেন সাধারণ মানুষ।
পদ্মা সেতুর কাঙ্খিত সুফল লাভ করতে নীতিনির্ধারকসহ সাধারণ নাগরিকদেরও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা, নাট খুলে টিকটক করা অথবা আবেগে আত্মহারা হলেই সেই সুফল লাভ সম্ভব হবে না। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে অভ্যাস ও আচরণে। কাঙ্খিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে সামষ্টিক প্রচেষ্টাই সফলতার সুবর্ণ বন্দরে পৌঁছে দিতে সহায়ক হবে।
লেখক: ব্যাংকার