ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচারলকের পদে (এমডি) এ পর্যন্ত ৫ জনকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত তাঁরা দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। একদল প্রভাবশালী মহলের কারনেই পদত্যাগ করতে হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রভাব খাটিয়ে পদটিতে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে হাজারো আবদার মিটিয়ে নিতে চায় এই মহল। এমন অবস্থায় খুব কম সংখ্যক এমডিই মেয়াদের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছে। সর্বশেষ এমডি তারিক আমিন ভূঁইয়াও নিজের ইচ্ছেমত কাজ করতে না পেরে পদত্যাগ করেন।এর আগে কাজী সানাউল হক ব্যক্তিগত কারন দেখিয়ে পদত্যাগ করলেও কিছুদিন পরই রাষ্ট্রায়ত্ব একটি ব্যাংকে যোগদান করেন।
সেই প্রভাবশালী মহল কারা? জানতে গত কয়েকবছর দায়িত্ব পালন করা সাবেক কয়েক জনের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ব্রোকার হাউজের মালিক এবং ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদই সেই প্রভাবশালী মহল।যাদের ইচ্ছার বাহিরে গেলেই পদত্যাগ করতে হয় এমডিদের।
জানা যায়, ডিএসইতে যোগদানের পর থেকে পরিচালনা পর্ষদের সাথে ধারাবাহিক মতবিরোধের কারনে তারিক আমিন তার মেয়াদের ১৩ মাস মধ্যেই পদত্যাগ করেন। গত বছরের ২৫ জুলাই ডিএসইতে যোগ দেন তারেক আমিন ভূঁইয়ার । ডিএসই পরিচালনা পর্ষদ ৪ জুলাই ২০২১ অনুষ্ঠিত ১০০৮ তম সভায় তাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেন, তারিক আমিন ভুঁইয়ার পদত্যাগের বিষয়টি ইমেইলের মাধ্যমে আমাকে জানিয়েছেন। এখানে যেভাবে কাজ করতে চাচ্ছেন, সেইভাবে পারছেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি অভিজ্ঞ একজন মানুষ। হয়তো ভালো কোথাও সুযোগ পেয়েছেন, তাই ডিএসই থেকে পদত্যাগ করেছেন।
এদিকে মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) ডিএসইর চেয়ারম্যানের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন তিনি। এমডি হিসেবে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে ডিএসইতে কাজ করতে না পারাকেই তিনি পদত্যাগের কারণ উল্লেখ করেছেন তারিক আমিন ভূঁইয়া।
ডিএসইতে দীর্ঘ সময় ধরে পদোন্নতি বন্ধ ছিল। চলতি সপ্তাহে ডিএসইর ৯৫ কর্মচারীর পদোন্নতিতে বেশ কয়েকটি সিনিয়র পদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এমন অবস্থায় ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আমিন ভূঁইয়ার পদত্যাগ এবং তার ৯৫ জন কর্মচারীর পদোন্নতির পুরো তথ্য জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এর আগে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে দায়িত্ব নেয়ার আট মাসের মাথায় ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর ডিএসইর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ছানাউল হক পদত্যাগপত্র জমা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৪ নভেম্বর এমডি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় ডিএসই। প্রার্থী বাছাই ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সিটিব্যাংক এনএর চিফ কান্ট্রি কমপ্লায়েন্স অফিসার (সিসিসিও) ও চিফ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অফিসার (সিএএমএলও) এম আশিক রহমানকে এমডি পদের জন্য সুপারিশ করে অনুমোদনের জন্য বিএসইসির কাছে পাঠায় ডিএসইর পর্ষদ। অবশ্য গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এম আশিক রহমানের যোগ্যতা, দক্ষতা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা ডিএসইর বোর্ড অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেগুলেশন ২০১৩-এ নির্ধারিত মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে তার নিয়োগের বিষয়টি বাতিল করে দেয় কমিশন। এরপর আবারো এমডি নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় এক্সচেঞ্জ। সেই বিজ্ঞপ্তির অনুসারে এ বছরের জুলাইয়ে তারিক আমিন ভূঁইয়া এক্সচেঞ্জটিতে এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। ডিএসইর ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক্করণ) পর থেকে এখন পর্যন্ত আট বছরে চারজন এমডি দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, বিনিয়োগকারীর স্বার্থে কাজ করতে হলে প্রথমেই প্রভাবশালীদের রাহুমুক্ত করতে হবে এমডিদের। কিন্তু ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বারবার প্রভাবশালীদের ধাক্কায় হোঁচট খাচ্ছে। তাই ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছিল মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে অধিক ক্ষমতাশালী করতে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আট বছর পর এসেও সংস্থাটি হাঁটছে সেই পুরনো পথেই।
ডিএসইর বোর্ড অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আইনের গভর্ন্যান্স স্ট্রাকচার অব এক্সচেঞ্জ’ শীর্ষক অধ্যায়ে এমডির দায়িত্ব হিসেবে বলা আছে, এক্সচেঞ্জের অবাধ, সুষ্ঠু, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করবেন। স্টক এক্সচেঞ্জের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে এমডিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু ডিএসইর বেশির ভাগ এমডিই সেখানে বাধাপ্রাপ্ত হন। এ কারণে অনেকে নিজ সম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করেন, অনেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। এতে ডিএসই সম্পর্কে নেতিবাচক এক ইমেজই তৈরি হচ্ছে বাজারে। যার কারণে ভালো সুযোগ-সুবিধার পরও যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা এক্সচেঞ্জের এমডি হতে আগ্রহ দেখান না।। বর্তমান এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পর্ষদকে বাদ দিয়ে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে পর্ষদের কেউ কেউ যেমন ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তেমনি পদোন্নতিবঞ্চিত অনেকের ব্যক্তিগত আক্রোশের মুখেও পড়েছেন। কয়েক জন স্বতন্ত্র পরিচালক ক্ষুব্ধ হন এমডির বিরুদ্ধে।
অতীতেও এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে সংস্থাটিতে। বিভিন্ন ইস্যুতে সাবেক বেশ কয়েকজন এমডিও তাঁদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে পর্ষদের কারও কারও বিরাগভাজন হয়ে বিদায় নিয়েছেন বা নিতে বাধ্য হয়েছেন। এ কারণে সংস্থাটির এমডি পদে এখন যোগ্য ব্যক্তিদের অনেকেই আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই অতীতে এমডি পদ শূন্য হওয়ার পর কয়েক দফায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও যোগ্য লোক খুঁজে পায়নি সংস্থাটি। সর্বশেষ বর্তমান এমডি তারিক আমিন ভূইয়ার নিয়োগের আগে প্রায় সাত মাস এ পদটি শূন্য ছিল।
ডিএসইর এমডির পদটি পরিবর্তনই একমাত্র পদ্ধতি মনে করা হচ্ছে। যোগ্যতা, দক্ষতা, পেশাদারিত্ব, সক্ষমতাএসবই যেন এ পদের বেলায় অসত্য। শুধু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এসব বিষয়ের উল্লেখ থাকে।
সুত্র জানায়, ডিএসইর এমডি পদে পেশাদারিত্ব চর্চা করতে গেলেই ব্যাপক ঝামেলা তৈরি হয়। গত ২২ বছরে ডিএসইর ১১ জন (বর্তমান এমডি বাদে) এমডি বদল হয়েছেন। এর মধ্যে কেবল তিনজন পূর্ণ মেয়াদে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। অন্যদের মেয়াদ পূর্তির আগেই হয় স্বেচ্ছায় বিদায় নিতে হয়েছে, নয়তাে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। একসময় ডিএসইতে ছিল ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ডিএসইতে ২৫০ সদস্য থাকলেও আধিপত্য বিস্তারের কাজটি করতেন হাতে গোনা কয়েকজন। তাঁদের হাত ধরেই অনেকে নিয়োগ পান। ডিএসইতে। এ কারণে প্রভাবশালীদের আনুকূল্য পাওয়া ভাইয়েরাও প্রভাব বিস্তার করেন নানাভাবে।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের এ প্রভাব ও ক্ষমতার বলয় থেকে ডিএসইকে মুক্ত করতে ২০১৪ সালে মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা বা ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছিল। কিন্তু ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আট বছর পরও প্রভাবশালীদের বলয়েই রয়ে গেছে । কারণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে মিলে নিজেদের পছন্দের স্বতন্ত্র পরিচালক বাছাই করে নিয়ে আসেন এই মালিকেরা। ফলে স্বতন্ত্র পরিচালকেরা কার্যত হয়ে গেছেন মালিকদেরই প্রতিনিধি।
অপরিদকে ডিএসইর শেয়ারধারী কিছুসংখ্যক মালিক যেমন কখনো চান না সংস্থাটি পেশাদারত্বের সঙ্গে চলুক, তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও ডিএসইতে পেশাদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি এখনো।