নেপালের সংবাদমাধ্যম কাঠমাণ্ডু পোস্টের খবরে বলা হয়, বিলটি পাস হওয়ার পর নেপালের আইনসভার স্পিকার অগ্নি সাপকোটা বলেন, ‘সভায় উপস্থিতি ২৫৮ সদস্যের সবাই বিলটির স্বপক্ষে ভোট দেওয়ায় এটি দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পেয়ে গৃহীত হয়েছে বলে আমি ঘোষণা করছি।’
গত ২০ মে নেপালের মন্ত্রিসভা দেশটির নতুন এ প্রশাসনিক মানচিত্র প্রকাশ করে, যা ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি করে। সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা অঞ্চল। এই অঞ্চলগুলোকে নিজেদের বলে দাবি করছে নেপাল। এ দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই কোমর বেঁধে নামেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি, যার প্রকাশ ছিল সেই নতুন মানচিত্র। এতে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারত। বিষয়টিকে নেপালের ‘একচেটিয়া’ পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছে নয়াদিল্লি। কিন্তু এত সবেও নেপাল পিছু হটেনি।
ক্ষমতাসীন দল এ সম্পর্কিত বিলটি আজ নেপালের আইনসভায় উত্থাপন করে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এতে বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেস সমর্থন জানায়। ফলে বিলটি পাস হতে সমস্যা হয়নি। এখন বিলটি নেপালের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ জাতীয় পরিষদে পাঠানো হবে। সেখানেও এটি ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে যাবে। আইনসভায় বিলটি উত্থাপন করেন নেপালের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী মায়া তুম্বাহাংপে। বিরোধী দল সমর্থন জানালেও তারা ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির মীমাংসা করার ওপর গুরুত্বারোপ করে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়, মানচিত্র সম্পর্কিত সংশোধনী বিলটি নেপালের জাতীয় পরিষদে উত্থাপনের পর এর কোনো ধারা নিয়ে আপত্তি থেকে থাকলে তা জানানোর জন্য সদস্যরা ৭২ ঘণ্টা সময় পাবেন। জাতীয় পরিষদের বিলটি পাস হওয়ার পর তা চলে যাবে প্রেসিডেন্টের কাছে অনুমোদনের জন্য। নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের পরই বিলটি দেশটির সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত হবে।
গত মাসে ওই অঞ্চলে ভারতের সড়ক নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন তুললে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু পিছু হটেনি নেপালের ক্ষমতাসীন দল। কাঠমাণ্ডু পোস্টের খবরে বলা হয়, নেপালের সরকারি দল গত মঙ্গলবার নিম্নকক্ষে বিলটি আলোচনার জন্য উপস্থাপন করে। সেখানে বিলটি আমলে নিয়ে সংবিধানে দ্বিতীয় সংশোধনী আনার বিষয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
শনিবারের বিশেষ অধিবেশনে বিলটির বিরুদ্ধে একমাত্র অবস্থান নেন সমাজবাদী পার্টির আইনপ্রণেতা সারিতা গিরি। তিনি লিপুলেখ, লিম্পিয়াধুরা ও কালাপানির নিয়ন্ত্রণ দাবি করার মতো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেপালের হাতে নেই বলে উল্লেখ করেন। তবে বিলটিতে তাঁর এই সংশোধনী প্রস্তাব স্পিকার খারিজ করে দেন। এর পরপরই সারিতা গিরি সভাকক্ষ ত্যাগ করেন।
তিব্বতের মানস সরোবরে লিপুলেখ হয়ে নতুন সড়ক চালু করার পর নতুন এই মানচিত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় নেপাল। গত মাসে নেপাল যে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, সেখানে দেখা যায় কালী নদীর পূর্ব পাশের এক চিলতে ভূমিকে (প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার) দেশটি তাদের মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করে, যা ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নেপালের উত্তর-পশ্চিমের প্রান্তের ওই এলাকার মধ্যে পড়েছে উত্তরাখণ্ডের লিপুলেখ এবং কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা এলাকা। এগুলো ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর থেকেই নয়াদিল্লির কাছে কৌশলগতভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। এই এলাকাগুলো এত দিন উত্তরাখণ্ড রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল হিসেবেই ভারত বিবেচনা করেছে। কৌশলগত অঞ্চল হওয়ায় এগুলোর জন্য রয়েছে ভারতের বিশেষ প্রহরাও।
ভারতের দাবি, নেপালরাজের বিরুদ্ধে ১৮১৪ সালে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পটিয়ালা ও সিকিমের রাজারাও কোম্পানির হয়ে যোগ দেন সে যুদ্ধে। দু বছর ধরে চলা সে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন নেপালরাজ। ১৮১৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে সন্ধি করেন তাঁরা। বিহারের সুগৌলীতে হওয়া সেই সন্ধিপত্রে নেপালের সীমানা নতুন করে নির্ধারিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী, পশ্চিমে মহাকালী থেকে পূর্বে মেচি পর্যন্ত এলাকা নেপালরাজের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে স্থির হয়। দু শতাধিক বছর ধরে নির্ধারিত এই সীমা নিয়ে এখনকার বিপত্তির মূলে রয়েছে মহাকালীর প্রকৃত উৎস নিয়ে বিতর্ক।
১৯৫০-এর দশকে চীন তিব্বত দখল করার পর নেপাল-চীন সীমান্তে বেশ কিছু সামরিক চৌকি বসিয়েছিল ভারত। নেপালের অনুমতি নিয়ে বসানো সেই চৌকিগুলো ১৯৬৯ সালে ভারতকে সরিয়ে নিতে বলে দেশটি। সে অনুযায়ী ভারত ১৭-১৮টি চৌকি সরিয়ে নেয়। কিন্তু সেখানে কালাপানি ছিল না। নেপালও আর আপত্তি করেনি। এর পরের দশকগুলোতেও কালাপানি, লিপুলেখ বা লিম্পিয়াধুরা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে লিপুলেখ, কালাপানি, লিম্পিয়াধুরা নিয়ে নেপাল জোরালো দাবি জানাতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রমে বিষয়টি নিয়ে তারা সোচ্চার হয়। শেষ পর্যন্ত আজ এ সম্পর্কিত সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব দেশটির আইনসভায় পাস হলো।
এ বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ভারতীয় কিছু এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করে তৈরি করার মাধ্যমে নেপালের মানচিত্রে বদল আনার জন্য দেশটির সংবিধান সংশোধনীর একটি প্রস্তাব আইনসভায় পাস হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান আমরা আগেই ব্যক্ত করেছি। এই দাবির কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা ও প্রামাণিক ভিত্তি নেই। তাই এটি সমর্থনযোগ্য নয়। সীমান্তের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের যে সমঝোতা আমাদের মধ্যে রয়েছে, এটি তাও লঙ্ঘন করেছে।’
এর আগে গত মাসে এ সম্পর্কিত প্রতিক্রিয়ায় শ্রীবাস্তব বলেছিলেন, ‘এই বিষয়ে ভারতের দীর্ঘকাল ধরে থাকা অবস্থান সম্পর্কে নেপাল অবগত। এ ধরনের মানচিত্র অনুমোদন থেকে বিরত থাকা এবং ভারতের সীমানা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য আমরা নেপাল সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি।’
কিন্তু নেপাল সরকার শেষ পর্যন্ত ভারতের সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এএনআইয়ের বরাত দিয়ে এনডিটিভি জানায়, আজ সকালে ভারতের সেনাপ্রধান এম এম নারাভান বলেন, ‘নেপালের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী। আমাদের মধ্যে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় সংযোগ রয়েছে। দু দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্কও অত্যন্ত শক্তিশালী। ভবিষ্যতেও আমাদের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক থাকবে বলে আমরা আশাবাদী।’
জেনারেল নারাভান যখন এমন প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, তখনো নেপালের আইনসভায় বিলটি পাস হয়নি। তিনি তাঁর বক্তব্যে নেপাল সরকারের এমন পদক্ষেপের পেছনে ‘অন্য কেউ’ থাকতে পারে বলেও ইঙ্গিত করেন। এই ইঙ্গিত সুস্পষ্টভাবেই চীনের দিকে। বিলটি পাস হওয়ার পর অবশ্য এ নিয়ে এখনো তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।