নিয়ম ভেঙে হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ রারাকাব’র

নিয়ম ভেঙে হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ রারাকাব’র
নিয়ম ভেঙে হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। হিসাব মিলছে না প্রায় ৪৮৮ কোটি টাকার। এছাড়াও দেড় শতাধিক কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। বিশেষায়িত ব্যাংকটির বিপুল অংকের এ টাকা কোথায় গেল, তার কোনো দালিলিক প্রমাণও নেই।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছে রাকাব। কিন্তু একই সময়ে ঋণ বিতরণ করেছে ৫ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। যা সরাসরি আইন লঙ্ঘনের শামিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ১০০ টাকা আমানতের মধ্যে ৮৫ টাকা বিতরণ করতে পারবে তফসিলী ব্যাংকগুলো। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এই নীতি ভঙ্গ করে শতকরা ১১৯ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। হিসাব করে দেখা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও এডিআর নীতিমালা ভঙ্গ করে ১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে আগামী ৭ তারিখ আমাদের একটি বৈঠক রয়েছে। আমরা আশা করি সেই দিনেই ব্যাংকের সঠিক তথ্য উঠে আসবে। এখন আমাদের সকল শাখা অনলাইন ভিত্তিক কাজ করছে দাবি করে তিনি জানান, পরবর্তীতে নিরীক্ষণের কোন প্রয়োজন হবে না। কারণ আমাদের সকল শাখাই এখন অনলাইনের আওতায় চলে এসেছে।

গত বছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের একটি শাখার বাৎসরিক লোকসানের পরিমাণ দেখিয়েছিল এক লাখ টাকা। কিন্তু পরবর্তীতে তা বেড়ে এক কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল। সুতরাং নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সব তথ্য ঠিক নাও হতে পারে। তিনি আরো জানান, একটা সময় ব্যাংকটি কোনরকম লাভ করতে পারত না। কিন্তু কয়েক বছর ধরে অন্তত লাভের মুখ দেখতে পারছে। ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

গত বছরের শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানতে একাধিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। এর অংশ হিসেবে সিরাজ খান বসাক এন্ড কোং এবং এম এম রহমান এন্ড কোং রাকাবে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। গত বছরের মাঝামাঝি প্রধান কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ শাখায় নিরীক্ষা শেষে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় নিরীক্ষক দল।

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৩৮১ শাখার মধ্যে এলপিও, রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা ও বগুড়া শাখাতে বিশেষ নিরীক্ষা শেষে ২৮ কোটি টাকা লোকসান পাওয়া যায়। বাকি ৩৭৬ শাখায় এখনও অডিট পরিচালিত হয়নি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এজেন্টের কাছ থেকে নেয়া ঋণের অংক ১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৩০৯ কোটি টাকার হিসাব মেলানো সম্ভব হলেও বাকি টাকার কোনো হদিস নেই। অর্থাৎ প্রায় ১৬৭ কোটি টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে অসমন্বিত রয়েছে প্রায় ১৭৪ কোটি টাকা। এছাড়া তথ্য গোপন করে কয়েকটি শাখা ২৮ কোটি টাকা লাভ দেখিয়েছে। কিন্তু নিরীক্ষকরা বলছেন, কোনো লাভ নয়, পুরো টাকাই লোকসান। রাকাবের প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন শাখার অসমন্বয় রয়েছে ৩০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে অসমন্বয় রয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল বলে প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উলেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের অধিকাংশ শাখায় কম্পিউটার অপারেটর অনভিজ্ঞ হওয়ায় কম্পিউটার পরিচালনায় অপারগতা প্রকাশ করে। যার ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিগত বছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সমাপনী হিসাবের সঙ্গে এ বছরের প্রাথমিকে হিসাবের তথ্যে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। রাকাবের বিভিন্ন শাখায় সফটওয়্যার ব্যবহার করা হলেও প্রধান কার্যালয়ের হিসাব সম্পাদনের জন্য কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয় না। যদিও প্রধান কার্যালয়ে সফটওয়্যার ব্যবহার করা খুবই জরুরি। তবে ব্যাংক বলছে, প্রধান কার্যালয়ে ইতিমধ্যে সফটওয়্যার সংযোগ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের নগদ জমা সংরক্ষণেও ঘাটতি রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী দেশের সব তফসিলি ব্যাংককে তাদের মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের ৫.৫ শতাংশ সাপ্তাহিক ভিত্তিতে এবং ন্যূনতম ৫ শতাংশ দৈনিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু দুই প্রকারের হিসাবেই ঘাটতি রয়েছে রাকাবের।

সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান রাকাব এসএমই ফাইন্যান্স লিমিটেডের শেয়ার মূলধন ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার লক্ষ্যে ৫৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেছে, এত টাকা বিনিয়োগের পরেও প্রতিষ্ঠানটির মূলধনে ৪২ কোটি টাকার বেশি অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।

নিরীক্ষকদের মতে, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নীতিমালা সঠিকভাবে পরিপালন করা হয়নি। এর জবাবে ২০২১ সালের মধ্যে সকল সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে ব্যাংকটি। আর্থিক বিবরণীতে শাখা সমন্বয় বাবদ প্রায় ৮১ কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো সমন্বয় রাকাবের বিবরণীতে নেই। ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, নওগাঁ এলাকার প্রসাদপুর শাখার প্রায় ১৮ কোটি টাকা পুনর্মূল্যায়ন করে ৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আর্থিক বিবরণীতে তা সমন্বয় করা হয়নি। নিরীক্ষা কালীন সময়ে ব্যাংকে কোনো ধরনের সমন্বিত কোর ব্যাংকিং সিস্টেম (সিবিএস) সফটওয়্যার ছিল না। এছাড়াও একটি ব্যবসায় সংগঠন বিলম্বিত করে দায় প্রদর্শন করতে বাধ্য। কিন্তু রাকাব কোনো ধরনের বিলম্বিত করার দায় প্রদর্শন করেনি।

রংপুর জোনের পীরগঞ্জ শাখার ঋণ ও অগ্রিমে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা প্রদর্শিত আছে। এর মধ্যে একজন গ্রাহকের কাছেই খেলাপি আছে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা। সুতরাং সংশ্লিষ্ট শাখা কর্মকর্তাদের খেলাপি ঋণ আদায় যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া বগুড়া উত্তর জোনের বড়াইহাট শাখা, বগুড়া দক্ষিণ জোনের জামগ্রামহাট শাখা, জয়পুরহাট জোনের বটতলী শাখা, নীলফামারীসহ ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় বিপুল অংকের ঋণ অসমন্বিত এবং খেলাপি হয়ে পড়েছে। এসব অর্থ আদায় বা সমন্বয়ের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই বলে অডিটে উলেখ করা হয়।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৭ সালে দেশের মঙ্গাপিড়িত এলাকার মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছিল রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তথা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কৃষিঋণ সরবরাহকারী বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান এটি। কিন্তু নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে চরম সংকটে দিন পার করছে ব্যাংকটি।

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

বিদেশি ডেবিট কার্ডে অর্থ তোলা বন্ধ করল ইবিএল
এসবিএসি ব্যাংকের নতুন এএমডি নূরুল আজীম
বছরজুড়ে আলোচনায় খেলাপি ঋণ, সুদহার ও বিনিময়হার
বিকাশের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মাহফুজ মারা গেছেন
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পর্ষদের ৩ কমিটি গঠন
ব্যাংকে চাকরির আবেদনের বয়সসীমা শিথিল
মাসিক সঞ্চয় হিসাব খোলা যাচ্ছে বিকাশ অ্যাপে
ফের এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন
অফিসার পদে ৭৮৭ জনকে নিয়োগ দেবে সরকারি ৫ ব্যাংক
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পরিচালক হলেন যারা