অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে দেয়া সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে ব্যাসেল-থ্রি মোতাবেক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারি গ্যারান্টি পত্র বা পারপেচুয়াল বন্ড ইস্যু প্রসঙ্গে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, কভিড-১৯-এর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত, বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। কভিড-১৯-এর প্রভাবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি আজ ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন, যার উল্লেখযোগ্য প্রভাব সমগ্র ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর পড়ছে। সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে সোনালী ব্যাংকের ওপর এর প্রভাব আরো বেশি হবে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যদিও কভিড-১৯-এর প্রভাব মোকাবেলায় এক লাখ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তদুপরি প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে সোনালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আগের বছরের তুলনায় প্রায় আটশ কোটি টাকা কম হবে বলে প্রতীয়মান হয়, যা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিকে আরো নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।
ব্যাসেল-থ্রি বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘২০২০ সালে ব্যাসেল-থ্রি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে ব্যাংকগুলোকে ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার বাবদ আড়াই শতাংশসহ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। তাছাড়া ডমেস্টিক সিস্টেমেটিক্যালি ইম্পর্টেন্ট ব্যাংকস (ডিএসসিআইবি’স) হিসেবে আড়াই শতাংশ এবং কাউন্টার সাইক্লিক্যাল ক্যাপিটাল বাফার (সিসিবি) বাবদ আড়াই শতাংশ হিসেবে আরো ৫ শতাংশসহ মোট সাড়ে সতেরো শতাংশ হারে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নেয়া হলে ২০২০ সালে এ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে আনুমানিক ১০ হাজার কোটি টাকা। নিট মুনাফা দ্বারা এই বিপুল পরিমাণ মূলধন ঘাটতি পূরণ স্বল্পমেয়াদে অসম্ভব।
নিট মুনাফা অর্জন দ্বারা ব্যাসেল-থ্রি মোতাবেক মূলধন ঘাটতি পূরণে ব্রাংকের দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হবে যা ব্যাসেল-থ্রি ডেডলাইন পরিপালনের অন্তরায়।’
সোনালী ব্যাংক বলছে, একমাত্র ট্রেজারি ব্যাংক হিসেবে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি বড় বড় এলসি খোলা হয়ে থাকে। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যোর একটি এলসি এ ব্যাংক থেকে খোলা হয়। বিপিসি, খাদ্য, খাদ্য সমরাস্ত্র, রেলওয়ে এসব মন্ত্রণালয় তো রয়েছেই। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকলে অনেক বিদেশী ব্যাংক এ ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে চায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা গ্রহণ করলেও অ্যাড কনফারমেশন ফি দাবি করে। এতে সরকারের এবং দেশের আমদানি ব্যয় প্রায় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়ে যায়। এ কারণে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ অত্যাবশ্যক।
এপ্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের এমডি মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, মূলধন ঘাটতি মেটাতে পারপেচুয়াল বন্ড ছাড়ার অনুমতি চেয়ে আগেও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। কভিড-১৯-এর থাবায় সারা পৃথিবীতেই ব্যবসা-বাণিজ্যর বেহাল দশা। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যাংকগুলোকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে ব্যাংকের প্রয়োজন। আবার ব্যাংকগুলোকেও ব্যবসা করতে হলে বিভিন্ন খাতে অর্থায়ন করতে হবে। বিভিন্ন দিকের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
চিঠিতে সোনালী ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো নগদ অর্থ সরবরাহের বিপরীতে সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংকের অনুকূলে সরকারি গ্যারান্টি পত্র ইস্যু করা এবং সেই গ্যারান্টি পত্রকে মূলধনের স্বীকৃতি দেয়া। অন্য আরেকটি বিকল্প হলো সরকার ব্যাংকটির অনুকূলে নামমাত্র কুপন হারে সরকারি পারপেচুয়াল বন্ড ইস্যু করা এবং সেই বন্ডের বিপরীতে সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যু করা।
প্রথম বিকল্প প্রস্তাবের ব্যাখ্যায় সোনালী ব্যাংক বলছে, নগদ অর্থ সরবরাহের বিপরীতে সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি পূরণের বিষয়টি সহজ নয়। এজন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হয়, যাতে সমালোচনার সম্মুখীন হতে না হয়।
দ্বিতীয় বিকল্প প্রস্তাবের ব্যাখ্যায় সোনালী ব্যাংক বলছে, হিসেবে মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার কর্তৃক সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে সরকারি গ্যারান্টি পত্র ইস্যু করা হলে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক তা মেনে নিলে কোনোরূপ নগদ লেনদেন ছাড়াই মূলধন ঘাটতি পূরণ সম্ভব। সরকারি গ্যারান্টি পত্র ইস্যু হলে তা ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতেও প্রকাশ করা যেতে পারে। গ্যারেন্টিকে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বীকৃতি দিলে তা সোনালী ব্যাংকের রেগুলেটরি মূলধনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং মূলধন ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের যেকোনো ধারায় জারি করা নির্দেশনা বাতিল, সংযোজন, বিয়োজন ও সংশোধন করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি যেকোনো ব্যাংককে তার পরিচালন থেকেও অব্যাহতি দিতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে গ্যারান্টিকে সিইটি-১ ক্যাপিটাল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে কোনো নগদ লেনদেন ছাড়াই মূলধন ঘাটতি পূরণ সম্ভব। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাসেল গাইডলাইনসের একটি ধারা, যেটি বিদেশী ব্যাংকগুলোর জন্য প্রযোজ্য, তা সোনালী ব্যাংকের জন্য প্রয়োগ করা যেতে পারে।
তৃতীয় বিকল্প হিসেবে সরকার কর্তৃক সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে নামমাত্র কুপন হারে সরকারি পারপেচুয়াল বন্ড ইস্যু করা হলে প্রাপ্ত বন্ডের বিপরীতে ব্যাংক কর্তৃক সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যু করে মূলধন ঘাটতি পূরণ সম্ভব বলেও জানিয়েছে সোনালী ব্যাংক। এ বিকল্পের ক্ষেত্রেও সরকারের মূলধন ঘাটতি পূরণে কোনো নগদ অর্থের প্রয়োজন হবে না। শুধু কুপন সুদের টাকার জন্য প্রতি বছর রেভিনিউ বাজেটে প্রভিশন রাখতে হবে। এ প্রক্রিয়া অনুসরণ অত্যন্ত সহজ এবং হিসাববিজ্ঞানের একটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে চিঠিতে।সূত্র: বণিক বার্তা/আরকে