প্রতি বছর শুধু খাদ্যশস্য আমদানিতেই বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশকে। ভোজ্যতেল, তেলবীজ, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, ডালবীজ, ফল ও মসলাপণ্যের ক্ষেত্রেও এখনো ব্যাপক মাত্রায় আমদানিনির্ভর রয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সঠিক পরিকল্পনাভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব পণ্যের আমদানিনির্ভরতা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এফএওর বার্ষিক পরিসংখ্যানে উপস্থাপিত ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে আমদানীকৃত কৃষি ও খাদ্যপণ্যের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক বলছে, এ সময়ে বার্ষিক গড়ে ৭২০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। চলতি বিনিময় হারের ভিত্তিতে রূপান্তরের পর বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশিতে। বিশ্বব্যাংকের উপস্থাপিত এ পরিসংখ্যানের বাইরে তুলা আমদানিকে আমলে নেয়া হলে দেশে খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিতে ব্যয় ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও তুলা আমদানিতে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে উপস্থাপিত তথ্য বলছে, তুলার বাইরে অন্যান্য কৃষি ও খাদ্যপণ্যের মোট আমদানি ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি খরচ হচ্ছে চারটি পণ্য আমদানিতে। এর মধ্যে ভোজ্যতেলেই ব্যয় হচ্ছে ২৬ শতাংশ (পাম অয়েলে ১৬ এবং সয়াবিন ও অন্যান্য ভোজ্যতেল ১০ শতাংশ)। এছাড়া গম ও চিনি আমদানিতে খরচ হচ্ছে মোট আমদানি ব্যয়ের যথাক্রমে ১৪ ও ১১ শতাংশ। এছাড়া মোট ব্যয়ের ৬ শতাংশ শুকনা সবজি আমদানিতে, ৬ শতাংশ চালে ও ৬ শতাংশ সয়াবিন বীজ আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে। পাশাপাশি দুধ ও ক্রিম আমদানিতে ৪ শতাংশ, ভুট্টায় ৩ ও পশুখাদ্যে ৩ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। এর বাইরেও অয়েল কেক, আপেল ও অন্যান্য ফল, পেঁয়াজ এবং অন্যান্য মসলার প্রতিটিতে ব্যয় হচ্ছে ২ শতাংশ করে। ১ শতাংশ করে ব্যয় হচ্ছে সাতটি পণ্য আমদানিতে। এগুলো হলো সিট্রাসজাতীয় ফল, আটা, ময়দা ও অন্যান্য পণ্য, আদা, জাফরান, হলুদ, ছোলা ও মত্স্যজাত পণ্য।
খাদ্য ও কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে আমদানিনির্ভরতা প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ পুলের সদস্য এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সাবেক মহাপরিচালক হামিদুর রহমান মনে করছেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে সক্ষম থাকলেও সে সুযোগ কাজে লাগানো হয়নি বাংলাদেশে। এর ফলে আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপও বেড়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দানাদার খাদ্যশস্য ছাড়াও অন্যান্য শস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে শস্যের বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি উদ্বৃত্ত উৎপাদনও হচ্ছে। সে অর্জনকে সামনে নিয়ে দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার।
কৃষি মন্ত্রণালয় বর্তমানে তেল ও ডালজাতীয় শস্যের আবাদ বৃদ্ধিতে কাজ করছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, এজন্য বোরো ও আমন মৌসুমে আরো উচ্চফলনশীল জাতের ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে সময়কাল কমিয়ে আনা হচ্ছে। এতে কয়েক লাখ হেক্টর জমি বেরিয়ে আসবে। তখন এসব জমিতে তেল ও ডালজাতীয় শস্য আবাদ করা সম্ভব হবে। আবহাওয়াগত বিষয় থাকায় গম উৎপাদন সে হারে না বাড়লেও উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানো হচ্ছে। মসলাজাতীয় শস্যের আবাদ এলাকা এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে। সেজন্য স্বল্প সুদে কৃষককে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি উদ্ভাবিত বিভিন্ন নতুন জাত কৃষকদের মধ্যে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সম্প্রসারণকর্মীরা মাঠ পর্যায়ে আমদানিনির্ভর ফসল আবাদে কৃষকদের উৎসাহ ও পরামর্শ দিচ্ছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ লাখ টন গম উৎপাদনের বিপরীতে আমদানি হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ টন। উৎপাদনে একধরনের স্থবিরতা থাকায় গম আমদানিতে ব্যয় ছাড়িয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। একই অবস্থা ভোজ্যতেল ও তেলবীজেও। এ দুই ধরনের পণ্যের চাহিদার সিংহভাগই পূরণ করতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। এসব পণ্য আমদানিতে প্রতি বছর বেরিয়ে যাচ্ছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে দেশে ডালশস্যের চাহিদার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পূরণ হচ্ছে স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে। এ চাহিদা প্রতিনিয়ত বেড়ে চললেও ডালশস্যের পণ্যের আবাদ কমছে ধারাবাহিকভাবে। ফলে গত ১০ অর্থবছরে ডালজাতীয় পণ্যের আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে গত কয়েক বছরে দেশে দুধের উৎপাদন দ্বিগুণ বেড়ে ৯৯ লাখ টনে উন্নীত হলেও পূরণ হচ্ছে না চাহিদা। এর পরও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ৫০ লাখ টন। ফলে এক্ষেত্রেও একধরনের আমদানিনির্ভরতা থেকেই যাচ্ছে। যদিও সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে দেশে উৎপাদনের মাধ্যমেই দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (বিডিডিএফ) সভাপতি অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি এমপি বলেন, আগামী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব। এজন্য শুধু তিনটি কাজ করতে হবে। প্রথমত গুঁড়া দুধ আমদানি, বিশেষ করে বাল্ক ফিল্ড মিল্ক আমদানিতে শুল্কহার বাড়াতে হবে। দেশেই গুঁড়া দুধের প্ল্যান্ট তৈরিতে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। দ্বিতীয়ত এ শিল্পের বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, জমির খাজনাকে বাণিজ্যিকের আওতা থেকে কৃষি খাতের আওতায় আনতে হবে এবং খামারিদের দুধ সংগ্রহ ও বাজারজাতের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার জন্য ২০ বছর আয়কর রেয়াত সুবিধার পাশাপাশি ভালো জাত উন্নয়ন, পশুখাদ্য ও চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে। বর্তমান সরকার এসব বিষয় বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।সুত্র:বণিক বার্তা