কিন্তু এর পরই শুরু হয়ে গেল বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক ভ্রমণকারীদের পছন্দের বিমানবন্দরটিতে এক বছর আগের তুলনায় এপ্রিল, মে ও জুনে এয়ার ট্রাফিকের পতন হলো ৯৯ শতাংশেরও বেশি। এ পরিস্থিতিতে চারটি টার্মিনালের দুটির কার্যক্রম স্থগিতের পাশাপাশি পিছিয়ে দেয়া হয় পঞ্চমটির নির্মাণ পরিকল্পনা। শুধু চাঙ্গিই নয়, পুরো বিশ্বের বিমানবন্দরগুলোর ব্যবসায় ধস সৃষ্টি করেছে করোনার সংক্রমণ। মূলত এয়ারলাইনস ও তাদের খরুচে যাত্রীদের অব্যাহত সমাগমের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানবন্দরের চিরাচরিত ব্যবসায়িক মডেলটি কভিড-১৯-এর থাবায় একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় আয় সৃষ্টির জন্য সম্পূর্ণ নতুন পথ খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন নিরুপায় বিমানবন্দর পরিচালকরা। যেমন ভ্রমণ করছে না, এমন সিঙ্গাপুরবাসীকে শুল্কমুক্ত কেনাকাটার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে চাঙ্গি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে বিমানবন্দরটির সংকটাপন্ন খুচরা বিক্রেতাদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া আয়ের জন্য পার্কিং লটকে ড্রাইভ-ইন মুভি থিয়েটারে রূপান্তর করা কিংবা অব্যবহূত জমিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ফার্ম স্থাপনের মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে বিভিন্ন বিমানবন্দর।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহযোগী ও এয়ারপোর্ট সিটি একাডেমির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ম্যাক্স হারশ বলেন, বিমানবন্দরগুলোর জন্য কভিড-১৯-এর গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, তাদের আয়ের উেস বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। অর্থ উপার্জনে বিমানবন্দরগুলোকে বেছে নিতে হবে এমন উৎস, যার বিষয়ে আগে কখনো ভাবা হয়নি। মূলত করোনা বিমানবন্দরের জন্য প্রাক-ভাইরাস যুগের থেকে একেবারেই নতুন বাস্তবতা হাজির করেছে। বৈশ্বিক বিমান পরিবহন খাত সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আগে এয়ারলাইনসগুলো আরো বেশি রানওয়ে, গেট ও টার্মিনালের বিষয়ে জোর দিত। কিন্তু এখন মহামারীর ভীতি ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদেরকে আকাশে উড্ডয়নের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। সর্বোপরি এয়ারলাইনসগুলোর সামনে হাজির হয়েছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
লন্ডনের গ্যাটউইক এবং এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রে আরো ৪৪টি বিমানবন্দরের পরিচালনাকারী সংস্থা ফ্রান্সের ভিঞ্চির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে যাত্রী ট্রাফিকে পতন হয়েছে ৯৬ শতাংশ। এছাড়া টোকিওর হানেদার পরিচালনাকারী জাপান এয়ারপোর্ট টার্মিনাল কোম্পানির প্রান্তিকটিতে পরিচালন ক্ষতি হয়েছে ১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। তাদের আয়ের পতন হয়েছে ৮৭ শতাংশ।
দি ইন্টারন্যশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন মনে করছে, আগামী বছরের মধ্যে বিমান পরিবহন শিল্পের ক্ষতি হবে ১০ হাজার কোটি ডলার। শঙ্কার বিষয় হলো, ২০২৪ সালের আগে খাতটির অবস্থা প্রাক-মহামারী অবস্থায় ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। এর চেয়েও দুঃসংবাদ হলো, ২০২৭ সালের আগে আন্তর্জাতিক ট্রাফিক ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়ার প্রভাষক ও বিমান পরিবহন নিয়ে গবেষণারত মিরজাম উইয়েডেমান বলেন, অধিকাংশ গ্রাহক ফিরে না এলেও ব্যবসার জন্য বিমানবন্দরের সুবিধাগুলো খোলা রাখতে হবে। কোনো সরকারই চাঙ্গির মতো বিমানবন্দর বন্ধ করে দিতে পারে না। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া একেবারেই অচিন্তনীয়।
এদিকে বড় অপারেটরগুলো ঋণদাতাদের কাছে সহায়তা প্রার্থনা করছে। এরই মধ্যে হিথ্রো এয়ারপোর্ট হোল্ডিংস জানিয়েছে, তারা ২০২১ সাল পর্যন্ত একটি চুক্তি মওকুফ নিশ্চিত করতে পেরেছে। একইভাবে ঋণদাতাদের কাছে সহায়তার প্রার্থনা করেছে ফ্রাপোর্ট এজি ফ্রাংকফুর্ট এয়ারপোর্ট সার্ভিসেস ওয়ার্ল্ডওয়াইড। অন্যদিকে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার অন্টারিও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর জুন ও জুলাইয়ে তাদের পার্কিং লটে শুভি থিয়েটার পরিচালনা করেছে। দীর্ঘমেয়াদে আয় সৃষ্টির লক্ষ্যে গত মাসে ৬২৭ একর জমিতে ১২০ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছে আলবার্টার এডমন্টন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এছাড়া ব্যয়সংকোচনের অংশ হিসেবে কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা করছে অনেক বিমানবন্দর। যেমন মোট ২ হাজার ৬০০ কর্মীর ২৫ শতাংশ ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি ৫ কোটি ১০ লাখ ডলার ব্যয়সংকোচনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে কোপেনহেগেন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। গত মাসে করপোরাসিও আমেরিকা এয়ারপোর্টস জানিয়েছিল যে তারা সংস্কার ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে চার মাসের জন্য এয়ারোপার্ক বিমানবন্দর বন্ধ রাখবে।
তবে মহামারী যে বিমানবন্দরগুলোকে শুধু বিপাকে ফেলেছে তা নয়; একই সঙ্গে নতুন ব্যবসার সম্ভাবনাও উন্মোচন করেছে বলে মনে করছেন অনেকে। এ বিষয়ে মেলবোর্নভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা এয়ারবিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রেগ ফোর্ডহাম বলেন, যাত্রীরা ফিরে আসার পর অর্থ উপার্জনের ব্যাপারে বিমানবন্দরগুলোকে সবকিছু নতুন করে ভাবতে হবে। এমনও হতে পারে যে তাদেরকে বিমানকর্মীদের জন্য হোটেলের ব্যবস্থাসহ যাত্রীদের খাবার থেকে চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করতে হতে পারে। ফলে করোনা সামনে ব্যবসার এমন সব সুযোগ হাজির করছে, যেগুলোর বিষয়ে বিমানবন্দরগুলো মোটেই ভাবেনি।
অকল্যান্ড বিমানবন্দরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদ্রিয়ান লিটলউড বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে পুনরুদ্ধার কেমন হবে, সে বিষয়ে এখনই কিছু স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকার সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হাজির হবে, আপনি এমনটি মোটেই আশা করতে পারেন না। খাতটিকে নিজের পায়ে নিজেকে দাঁড়ানোর পাশাপাশি উত্তরণেরও পথ খুঁজে নিতে হবে।
সুত্র: ব্লুমবার্গ