সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ৮১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারের ব্যাংক ঋণস্থিতি ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা।
সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) ঋণ বেড়েছে ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা।
যদিও আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণের অঙ্ক ছিল ২ লাখ ২ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছর এবং অর্থবছর-সব হিসাবেই ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার অঙ্ক অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
বাড়তি ঋণের পুরোটাই নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। তবে এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের পুরোনো ঋণ আংশিক পরিশোধ করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক টাকা ছেপেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে টাকা থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাবে। ফলে বাড়বে মূল্যস্ফীতিও। সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা থাকবে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে সরকার ঋণ নিচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রাস্ফীতি উভয় বাড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদায়ি বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। যা আগের বছর ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা।
সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণস্থিতি ছিল ৫৫ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা।
সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। যদিও আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণের অঙ্ক ছিল মাত্র ২৪ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছর এবং অর্থবছর-সব হিসাবেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার অঙ্ক অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত সরকার বাজেট বাস্তবায়নে অর্থবছরের শেষদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে থাকে। আবার পরের অর্থবছরের শুরুতে আয় বাড়লে সে ধার পরিশোধ করে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ধার নেওয়া বাড়িয়েছে সরকার। কারণ, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন আর সরকারের ব্যয়ের সঙ্গে আয় কম হওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ঋণ গ্রহণ করেনি। উলটো আগের ঋণ থেকে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল। অথচ চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
জানা গেছে, উন্নয়ন কাজের ব্যয় বা বাজেট বাস্তবায়নের জন্য যে কোনো সময় ট্রেজারি বন্ড বা ট্রেজারি বিল ইস্যু করতে পারে সরকার। এর বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ ধার নিয়ে তার ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু ঋণের বিপরীতে বাজারভিত্তিক সুদের হার না থাকা ও ব্যাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিকে ঝুঁকেছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ব্যয় বেড়েছে। অপরদিকে ঋণের বিপরীতে বাজারভিত্তিক সুদহার না থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপরও চাপ তৈরি হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সরকারকে ঋণ বাড়িয়ে না দেয় তাহলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনার দিকে মনোযোগী হবে। এতে দেশের ঋণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগে সুদহার প্রায় ৯ শতাংশ বা তার বেশি এবং এতে কোনো ঝুঁকিও থাকে না। অপরদিকে ঋণ বিতরণ ও উত্তোলনে ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকি নিতে হয়। তাই ব্যাংকগুলোকে যদি অধিক পরিমাণে বিল ও বন্ড কেনার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে তারা শূন্য ঝুঁকির বিল আর বন্ডই কিনবে। অপরদিকে ঋণ বিতরণ কমিয়ে দেবে। এতে দেশের শিল্প খাত ক্ষতির মুখে পড়বে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়ালেও সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ধারের অঙ্ক কমানোর চেষ্টা করছে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংকের তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলোর পুরোনো ঋণ পরিশোধে মনোযোগ দিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের অঙ্ক ছিল ২ লাখ ৬ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এক বছর পর ২০২২ সালে যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ কমেছে ২৫ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের শুরুতে ঋণের অঙ্ক ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে অর্থ বছরের প্রথম ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ পরিশোধ করেছে ৩৬ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে তা থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৩৬ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার।