কয়েকদিন ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে অবাধে। নিউইয়র্ক মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জে (নিমেক্স) গত সপ্তাহেও ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। শুক্রবার মার্কিন বাজার আদর্শটির সাপ্তাহিক বাজার স্থির হয়েছিল প্রতি ব্যারেল ৬৬ ডলার ৭৪ সেন্টে। সেখান থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশ কমে গতকাল সাপ্তাহিক বাজারের প্রথম দিনে একপর্যায়ে তা নেমে আসে ব্যারেলপ্রতি ৬৪ ডলার ৮৬ সেন্টে।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম শুক্রবার দিন শেষে ছিল প্রতি ব্যারেল ৭২ ডলার ৯৭ সেন্ট। সেখান থেকে আরো ২ দশমিক ৮ শতাংশ কমে গতকাল একপর্যায়ে তা নেমে আসে ৭০ ডলার ৯০ সেন্টে।
ডব্লিউটিআই ও ব্রেন্টসহ জ্বালানি তেলের প্রায় সব বাজার আদর্শেই এখন মূল্য নেমে এসেছে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের পর সর্বনিম্নে। বৈশ্বিক আর্থিক খাতের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিগগিরই পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম।
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। দেশে পণ্যটির ৯৮ শতাংশই আমদানি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার প্রভাবে সংস্থাটির জ্বালানি তেল আমদানি বাড়লেও এ বাবদ ব্যয় অনেকখানিই কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিপিসির সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সংস্থাটির জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ ব্যয় কমেছে অন্তত ৪২ কোটি ডলার।
ব্যয় কমলেও দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে এখনো প্রস্তুত নয় বিপিসি। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ চুক্তির শর্তে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি মাসেই বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলা রয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত দাম নিম্নমুখী থাকলেও এখনো দেশের বাজারে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। জ্বালানির দাম কমলেই সঙ্গে সঙ্গে দেশে কমানো সম্ভব হয় না। এলসি বা ক্রয়াদেশে যে মূল্য থাকে সে দামেই জ্বালানি কেনা হয়। জ্বালানি তেলের এলসি করার পর আমদানি, পরিশোধন ও মজুদ করা হয়। নতুন দামে কেনা জ্বালানি বাজারে ছাড়ার আগে পুরনো মজুদ শেষ করতে হয়। সব মিলিয়ে আমদানির পর জ্বালানি তেল চূড়ান্ত ক্রেতার হাত পর্যন্ত পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যায়। দেশের বাজারে এখন যে জ্বালানি তেল পাওয়া যায় তা আগে করা এলসির ভিত্তিতে আমদানীকৃত। ফলে এখনই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে জ্বালানি তেলের দাম কমানো সম্ভব নয়।
বিষয়টি নিয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ এনডিসিসহ ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের বাজারদর নিম্নমুখী হয়ে ওঠার পেছনে প্রধানত বৈশ্বিক ব্যাংক খাতের সংকটকেই দায়ী করছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনের পর পশ্চিমা দেশগুলোয় খাতটি ঘিরে রীতিমতো আতঙ্ক দেখা দেয়। এ আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে তোলে ক্রেডিট সুইসের ধসের আশঙ্কা। পরবর্তী সময়ে সুইস ব্যাংক ইউবিএস ক্রেডিট সুইসকে অধিগ্রহণের ঘোষণা দিলেও খাতটির বর্তমান দুর্দশা নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না বিনিয়োগকারীদের। বৈশ্বিক পুঁজিবাজারে গতকালও ব্যাংক খাতের শেয়ার ও বন্ডের দাম ছিল নিম্নমুখী।
জ্বালানি তেল উত্তোলন ও রফতানিকারকদের সংগঠন ওপেক প্লাসও পণ্যটির বর্তমান বাজার পরিস্থিতির পেছনে ব্যাংক খাতের দুর্দশাকেই দায়ী করছে। জোটসংশ্লিষ্ট সূত্রদের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের মতোই আর্থিক খাতে বড় আরেকটি ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জ্বালানি তেলের বাজারে উদ্বেগের আরেকটি বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে ফেডের সুদহার বৃদ্ধির সম্ভাবনা। আগামীকাল এ-সংক্রান্ত একটি ঘোষণা আসার কথা রয়েছে। রয়টার্সের এক জরিপের তথ্যানুযায়ী, ওইদিনের বৈঠকে ফেড সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট (দশমিক ২৫ শতাংশ) বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর্থিক ও মুদ্রাবাজারের বর্তমান অস্থিতিশীলতার মধ্যে এ সিদ্ধান্ত খাতটির সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলবে বলে আশঙ্কা বিনিয়োগকারীদের অনেকের। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এখন ফেডের প্রতি এ মুহূর্তে সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব্যাংকের কমোডিটি রিসার্চ বিভাগের প্রধান বাডেন মুর রয়টার্সকে বলেন, ‘অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গোটা বাজারে সবার মনোযোগ এখন ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা ও ফেডের সুদহার বাড়ানোর সম্ভাবনার ওপর নিবদ্ধ।’
অনেকটা একই বক্তব্য দিয়ে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আইএনজি ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক নোটে বলা হয়, আগামী আরো কিছুদিন গোটা আর্থিক খাত নিয়ে আশঙ্কা বৃহদায়তনে জ্বালানি তেলের বাজারে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।
কিছুদিন আগেই চলতি বছরের পুরো সময় ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের উত্তোলন কমানোর ঘোষণা দেয় ওপেক প্লাস জোট। ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২৩ শেষে জোটভুক্ত দেশগুলোর দৈনিক উত্তোলন গত বছরের তুলনায় ২০ লাখ ব্যারেল কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজারে পণ্যটির দাম বাড়ানোর এ প্রয়াসও পণ্যটির বাজারকে উত্তোলনকারীদের লক্ষ্যমাফিক ঊর্ধ্বমুখী করতে পারছে না। আগামী আরো কিছুদিন বাজারে এ পরিস্থিতি চালু থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।