সোমবার বিশ্বগণমাধ্যমের খবর ছিল, এ সপ্তাহে সর্বকালের সর্বোচ্চ উষ্ণতা ছিল ইউরোপে। তাপপ্রবাহের প্রখরতায় প্রতি বছর ইউরোপজুড়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়, ইউরোপের বেশ কিছু দেশে ইতোমধ্যেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে প্রাণঘাতী তাপদহন।
‘রেড অ্যালার্ট জারি ইতালিতে, তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি
লাগামহীন তাপপ্রবাহে ভয়াবহ পরিস্থিতি ইউরোপের শহর ইতালিতে। মঙ্গলবার ইতালির সার্ডিনিয়া এবং সিসিলিতে তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রিতে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ইতোমধ্যেই দেশটির ২৭টি শহরে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা থেকেই সুইস আলপ্সের দাবানল ঠেকাতে কাজ করছে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা। আগুনের ভয়াবহতা সীমান্তের কাছাকাছি হাউতে-ভালাইস এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০ জন উদ্ধারকর্মীসহ বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত ছিল। দূষণ রোধে স্থানীয়দের জানালা বন্ধ করে বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন করে মঙ্গলবার ইতালির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নাগরিক ও দর্শনার্থীদের জন্য নতুন কিছু নিয়ম করা হয়েছে। যেমন, সূর্যের বিকিরণ এড়িয়ে চলা, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া, ছাতা ব্যবহার, কমপক্ষে ১.৫ লিটার পানি পান করা, হালকা খাবার ও আরামদায়ক পোশাক পরিধান করা ইত্যাদি।
দাবানলের থাবায় গ্রিস ও স্পেন, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি
অত্যধিক তাপ রীতিমতো ‘ভাজা ভাজা করে দিচ্ছে স্পেন ও গ্রিসকে। রাতারাতি দাবানলে ছারখার এথেন্সের বনগুলো। প্রথম দাবানলটি দেশটির ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে কুভারাসে শুরু হয়েছিল। পরে দেশটির প্রেস এজেন্সি জানিয়েছে, জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত লৌতরাকির ইস্টমাস অঞ্চলে প্রবল বাতাসে বনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন ফুলকির মতো জ্বলে ওঠে এবং দক্ষিণে অ্যাটিকা, লাগোনিসি, অ্যানাভিসোস এবং সারোনিদা রিসোর্টে ছড়িয়ে পড়ে। এথেন্সের দক্ষিণে সারোনিদা গ্রামে আগুন নেভাতে ২৩০ জন দমকল বাহিনী লেগেছে। আরও ১৪০ জন দমকল বাহিনী দেশটির ডেরভেনোচোরিয়ায় আগুন নেভাচ্ছে। ছয়টি বিমান ও একটি হেলিকপ্টার এ কাজে সাহায্যে করছে। ইতোমধ্যেই দুর্যোগপূর্ণ এলাকা থেকে ১১২ জনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ধোঁয়ার ঘনঘটায় কালভিয়ার রাস্তাঘাটে গাড়ি চলাচল বন্ধ করেছে কর্তৃপক্ষ। বাসিন্দাদের বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা জানিয়েছেন, সমুদ্রতীরবর্তী একটি রিসোর্টের বাইরে ১২০০ শিশুকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্প্যানিশ মেট অফিস অনুসারে, গতকাল ভিলাররোব্লেডোর তাপমাত্রা শহরে ৪৭.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। কেন্দ্রীয় শহর আন্দুজার তাপমাত্রা ছিল ৪৪.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
৫২.২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় জ্বলছে চীন
জুলাইয়ের মাঝামাঝি চীনের দাবদাহ পূর্বের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সোমবার দেশটির উত্তর-পশ্চিমের তাপমাত্রা ৫২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে (১২৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পৌঁছেছে। চীনের আবহওয়া প্রশাসন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘জিনজিয়াং অঞ্চলের সানবাও গ্রামের তাপমাত্রা ১৬ জুলাই স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় সর্বোচ্চ ৫২.২ সেলসিয়াসে রেকর্ড করা হয়েছে।’ বিবৃতি অনুসারে, ২০১৭ সালে একই গ্রামে তাপমাত্রা ৫০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, যা এ বছর ছিল সর্বোচ্চ। শহরজুড়ে চলছে কড়া সতর্কবার্তা। সানবাও শহরের তুর্পানে শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবহওয়া সংস্থা থেকে যানবাহনসহ প্রধান সড়কগুলোতে পানি ঢালার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এদিকে টাইফুন তালিমের প্রভাব থেকে বাঁচতে গুয়াংডং থেকে ২৩০,০০০ মানুষ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষ গ্রীষ্মের এই চরম বৈরীভাবকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘মৃত্যু উপত্যকা’র ভয়াল রূপ, তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রি
উচ্চ তাপমাত্রায় ‘বিপজ্জনক’ অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমের কেন্দ্রীয় কিছু অঞ্চল। আবহওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, ‘টেক্সাস থেকে লোয়ার মিসিপিসি উপত্যকা এবং দক্ষিণ ফ্লোরিডা পর্যন্ত এ সপ্তাহে রেকর্ড ব্রেকিং তাপমাত্রার সম্ভাবনা রয়েছে।’ নৈসর্গের এক অদ্ভুত সৌন্দর্য ক্যালির্ফোনিয়ার ‘মৃত্যু উপত্যকা’। রোববার এর তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৩১ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। দক্ষিণ-পশ্চিমে তাপমাত্রার প্রখরতা এতটাই তীব্র ছিল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পার্কে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তবে একপ্রকার নিষেধ অমান্য করেই দর্শনার্থীরা ছুটছে ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে। রেকর্ড ভাঙা সবচেয়ে উষ্ণ তাপমাত্রা উপভোগ করতেই ভিড় জমাচ্ছে তারা। কেউ কেউ সেখানকার ফুমেস ক্রিক ভিজিটর সেন্টারে দাঁড়িয়ে পোজ দিয়ে তুলছে ছবি। ডজনখানেক লোক আবার মজার ছলে গায়ে পশমের কোট জড়িয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছে ছবি তোলার জন্য। সোমবার ‘র্যাবিট ফায়ার’ নামক ভয়াবহ আগুনে ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় ৮০০০ একর জমি পুড়ে গেছে। বিপজ্জনক তাপমাত্রায় অ্যারিজোনা ও টেক্সাসের বেশকিছু এলাকায় ৩০ দিনের বেশি সময় সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ১০৪ মিলিয়ন মানুষ সতর্কবার্তার মধ্যে রয়েছে। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর অ্যারিজোনার বাসিন্দারা গরমে রীতিমতো লড়াই করে চলেছে। ফ্রিনিক্সের রাস্তা ঘুরলে ১,১০০ গৃহহীন মানুষ পাওয়া যাবে। তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে তাদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ তাপপ্রবাহ ২৮ জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
জ্বলছে ইরান, বিমানবন্দরে তাপমাত্রা ৬৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ইরানও। বরং পরিস্থিতি বেশ ভয়াবহ সেখানে। সম্প্রতি দেশটির এক বিমানবন্দরের তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৬৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলার পার্সিয়ান গালফ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। প্রবল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং প্রচুর বায়ুমণ্ডলীয় আর্দ্রতার একসঙ্গে উপস্থিতিতে রোববার ইরানের পারস্য উপসাগরীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রেকর্ড ব্রেকিং তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয়।
মেক্সিকোয় মৃত অন্তত ১০০, তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি
চলতি জুন মাসে টানা তিন সপ্তাহ ধরে তাপপ্রবাহ চলেছে মেক্সিকোতে। তার জেরে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাল দিতে বন্ধ রাখা হয়েছে বেশ কিছু এলাকার স্কুল, কলেজের ক্লাস। তীব্র দাবদাহে জেরবার মেক্সিকো। গত দু’সপ্তাহে সে দেশে গরমের কারণে মারা গেছেন প্রায় ১০০ জন। দেশের কিছু অংশে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বৃহস্পতিবার এই তথ্য দিয়েছে সে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
জার্মানিতে বয়স্কদের হুঁশিয়ারি, তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি
সপ্তাহান্তে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে শুক্রবার সরকার বয়স্ক, স্বাস্থ্য সমস্যায় থাকা ব্যক্তি, গর্ভবতী মহিলা এবং ছোট বাচ্চাদের বিশেষভাবে সতর্ক করেছে। দেশটির আবহাওয়া সংস্থা ডিডব্লিউডি জানিয়েছে, ৩৭ ডিগ্রি (৯৯ ডিগ্রি ফারেনহাইটের) উপরেও যেতে পারে। এদিকে অস্ট্রিয়ায় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পৌঁছানোর পরপরই তাপমাত্রা মোকাবিলায় বিশেষ বার্তা প্রদান করা হচ্ছে। এমনকি হট লাইনে বিজ্ঞাপনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য ক্যারিন্থিয়ায় ৯০০টিরও বেশি কেয়ার হোম, হাসপাতালে তাপ সুরক্ষার বিশেষ স্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিকারী বিট প্রিটার মানুষের পাশাপাশি পশুদের প্রতিও যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। দাবানলের আগ্রাসন থেকে বাদ যায়নি কানাডাও।
জাপানে বৈরীভাব, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি
এশিয়ার মধ্যে জাপানে ইতোমধ্যেই ৪৭টি প্রদেশের মধ্যে ২০টিতে হিট স্ট্রোকে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। রাজধানী টোকিওসহ বেশ কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে। রোববার চার দশকের বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ফুকুসিমার অন্তর্গত হিরেনো শহরে (৩৭.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। উচ্চ এ তাপমাত্রা বড় বড় এলাকাগুলোকে রীতিমতো ঝলসে দিচ্ছে।