বৈশ্বিক জ্বালানি খাতে আগামী এক দশকে প্রযুক্তি বা রাজনীতির বদলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বিনিয়োগ। বিশেষ করে এ খাতে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন। গত কয়েক বছরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটলেও এখনো তা পর্যাপ্ত নয়। আগামী দিনগুলোয় কার্বন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে পরিমাণ বিদ্যুতের জোগান দিতে হবে, তার পেছনে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৈশ্বিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডেভিড ফিকলিং সম্প্রতি দাবি করেছেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও পিছিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো। সেক্ষেত্রে বড় জায়গা ধরে রেখেছে জীবাশ্ম জ্বালানি। বৈশ্বিক জ্বালানি তেল ও গ্যাস রফতানিকারক দেশগুলো নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার রেখেছে। ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোয় জ্বালানি নীতিমালা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অথচ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশের বসবাস এসব দেশে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি প্রধানত বৈদেশিক আয়ের ওপর নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে তাদের জ্বালানি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগ দরকার। যদি উন্নত দেশগুলো এসব দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ না করে, বিকল্প হিসেবে তারা জীবাশ্ম জ্বালানির দিকেই ঝুঁকবে বলে মনে করছেন জলবায়ুসংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি তেল থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। উভয় দেশই নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। পাকিস্তান ও মিসরের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করেছে সৌদি আরব। ফিলিপাইনের সঙ্গে তারা ৪৩০ কোটি ডলারের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইন্দোনেশিয়াও নতুন রাজধানী নুসানতারার অবকাঠামোগত উন্নয়নে রিয়াদের দ্বারস্থ হয়েছে। অন্যদিকে চীনের পর আফ্রিকায় বিনিয়োগে এগিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইথিওপিয়া, কেনিয়া, নাইজেরিয়া ও তানজানিয়ায় জোরালো প্রভাব রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের। ভারতে জ্বালানি তেল পরিশোধনের একটি প্রকল্পে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যথাক্রমে ১০ হাজার কোটি ও ৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে, যা হবে এ খাতে বিশ্বের বৃহৎ প্রকল্পগুলোর একটি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বিদেশী শ্রমের একটি বড় অংশ যায় মিসর, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও ফিলিপাইন থেকে। অন্যদিকে পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে আরবদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বেশ দৃঢ়। ফলে অর্থনৈতিকভাবে তারা মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানিনির্ভর দেশগুলোর প্রতি নির্ভরশীল। এদিকে চীন বেল্ট অ্যান্ট রোট ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে ২০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করা হয়েছে ১২৮ গিগাওয়াট জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনের জন্য, যার অধিকাংশই ব্যয় হয়েছে কয়লা ও গ্যাসের পেছনে। অবশ্য দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং অঙ্গীকার করেছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাওয়ার পথ অতটা সহজ নয় দেশটির জন্য। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশটির নিজস্ব অর্থনীতিও খুব একটা দাপুটে অবস্থার মধ্যে নেই। এশিয়ার আরেক দেশ জাপান কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিলেও তার গতি মন্থর।
ডেভিড ফিকলিং বলেন, ‘পরিবেশের অনুকূল জ্বালানি সম্প্রসারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিদেশী বিনিয়োগের দরকার। আর যেহেতু জ্বালানি খাতের পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে না পারায় কপ২৮ সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়। যদি ধনী দেশগুলো বিনিয়োগ করতে না চায়, তাহলে অন্য কেউ সে জায়গা দখল করে নেবে।’