আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও একই রকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে- যেসব ব্যাংকে সুদের হার কম, সেসব ব্যাংকে আমানত বেড়েছে। ব্যাংকের চেয়ে সুদের হার বেশি হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত কমে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষ আর ঠকতে চায় না। তাই মানুষ এখন অনেক ভেবে-চিন্তে প্রতিষ্ঠান বাছাই করে তারপর আমানত রাখছেন।
সাধারণত ঋণ বিতরণের স্বার্থে সর্বনিম্ন তিন মাস থেকে তিন বছর বা তারও বেশি সময়ের জন্য ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের কারণে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই গত ১ এপ্রিল থেকে আমানতে ৬ শতাংশ সুদহারের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এই সীমা না মেনে যেসব ব্যাংক বেশি সুদে আমানতের অফার দিচ্ছে, সেই ব্যাংকগুলোতে মানুষ যেতে চাইছে না। তবে যেসব ব্যাংকে সুশাসনের পাশাপাশি অনিয়ম-দুনীতি কম, সেসব ব্যাংকে বেড়েছে আমানত প্রবৃদ্ধি। করোনাকালে আমানত প্রবৃদ্ধির শীর্ষে রয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক। তবে টাকার পরিমাণের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি আমানত বেড়েছে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের। যদিও দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ব্যাংক। ব্যাংকটি তিন থেকে ছয় মাসের কম সময়ের আমানতে সুদ দিচ্ছে ৭ শতাংশ হারে, ছয় মাস থেকে এক বছরের কম সময়ের জন্য ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং এক বছর থেকে তার বেশি সময়ের জন্য আমানতের সুদ দিচ্ছে সাড়ে ৭ শতাংশ।
অন্যদিকে নন-ব্যাংকিং তথা আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতে সুদের হার ১০ শতাংশের ওপরে। কিন্তু তবুও এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমানত চলে যাচ্ছে অল্প সুদের ব্যাংকগুলোতে। অবশ্য করোনার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রধান হাতিয়ারই দুর্বল হয়ে পড়েছে, ঋণ বিতরণে ব্যাংকের মূল শক্তি দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ী আমানত কমে গেছে। ব্যাংকের মোট আমানতের প্রায় অর্ধেক জোগান আসে এই খাত থেকে।
করোনা মহামারিতে এপ্রিল থেকে জুন তিন মাসে দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ী আমানতের পরিমাণ কমেছে ১৩ হাজার ৯৪৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এই তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকের আমানত রাখা গ্রাহক কমেছে পৌনে দুই লাখ। জানা গেছে, গত মার্চ শেষে মেয়াদি আমানতের হিসাবের সংখ্যা ছিল ৪৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৭টি। জুন শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ লাখ ৯১ হাজার ৪৪৩টি। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে হিসাবের সংখ্যা কমেছে এক লাখ ৭৩ হাজার ১৩৪টি।
জানা গেছে, এপ্রিল-জুন সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমেছে ৩৮০ কোটি টাকা। খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এই কারণে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলে নিয়েছেন। যদিও এপ্রিল-জুন সময়ে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৫৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।
দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর জুন-ভিত্তিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথমার্ধে আমানতে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে বড় ও ভালো ভাবমূর্তিতে থাকা ব্যাংকগুলোর। এই সময়ে ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমানতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংকের। তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে ট্রাস্ট ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। যদিও ব্যাংকটি স্থায়ী আমানতের জন্য সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি সুদও দিচ্ছে না। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমানতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে দ্য সিটি ব্যাংকের। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। আমানত প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
করোনাকালে আমানত প্রবৃদ্ধিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির আমানত প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ২০ শতাংশ।
জানা গেছে, গত মার্চে দেশের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। জুন শেষে আমানত কমে হয়েছে ৪৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। গত এপ্রিল-জুন এই তিন মাসে ৩৭৯ কোটি টাকা আমানত কমে যায়।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত সেপ্টেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের তিনটি বিশেষায়িতসহ মোট ৯টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক আমানতের বিভিন্ন মেয়াদে সাড়ে ৪ থেকে ৬ শতাংশ সুদ অফার করছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, জনতা, বেসিক, বিডিবিএল-এর সুদহার ৫ দশমিক ৫০ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত। অবশ্য রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ দিচ্ছে আমানতকারীদের। ব্যাংকটি তিন মাস থেকে এক বছরের কম সময়ের সুদ ৪ দশমিক ৫০ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ, তিন বছর বা তার বেশি সময়ের সুদহার ৬ থেকে ৯ শতাংশ।
দীর্ঘমেয়াদি আমানতে সবচেয়ে বেশি সুদ ঢাকা ব্যাংকের। ব্যাংকটি তিন বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য আমানতে সুদ দিচ্ছে ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। তিন বছরের কম সময়ের এফডিআরে ব্যাংকটির সুদহার সাড়ে ৫ থেকে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।
তিন মাস থেকে তিন বছর বা তার বেশি সময়েরর জন্য সাউথবাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসএবিসি) সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। দুই বছরের বেশি সময়ের আমানতে পূবালী ব্যাংক দিচ্ছে ৮ শতাংশ সুদ। এক বছর পর্যন্ত এফডিআরেই সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ দিচ্ছে মেঘনা ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড আমানতের মুনাফা দিচ্ছে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত। দীর্ঘমেয়াদি আমানতে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদ দিচ্ছে দ্য সিটি ব্যাংক। এছাড়া বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংকেরই এফডিআরে সুদহার ৬ শতাংশ।
অর্থসংবাদ/ এমএস