আমাদের কর্মের ফলই আমাদের পরিচয়

আমাদের কর্মের ফলই আমাদের পরিচয়
আমি প্রায় চল্লিশ বছর হলো বাংলাদেশ ছেড়েছি। সুইডেনে বেশির ভাগ সময় কাটলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করা থেকে শুরু করে শিক্ষা এবং কর্মের সুযোগ পেয়েছি। বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণও করেছি। বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ এবং ভাষার মানুষের সঙ্গে উঠাবসা, চলাফেরা এমনকি একত্রে বসবাস করেছি। আমি বর্তমানে যেখানে বাস করছি সেখানে আমিই একমাত্র বাংলাদেশি বাকি সব সুইডিশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাগরিক। সবাই যেমন দেখতে এক রকম না আবার সবার ধর্ম, বর্ণ ভাষাও এক না। সুইডেনে থাকি সেক্ষেত্রে সবাই সুইডিশ ভাষায় কথা বলি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে। আমি যেহেতু শুরুতে পড়াশুনো করতে এখানে এসেছি সেক্ষেত্রে সুইডিশ ভাষা শেখা প্রশিক্ষণের একটি বিশেষ অংশ ছিল। অনেকে তার নিজ নিজ দেশ থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পরে এখানে এসে ভাষা শিখে চাকরিতে ঢুকেছে। সুইডিশ ভাষা না জানলে চাকরি পাওয়া কঠিন। তবে এ পর্যন্ত শুনিনি যে চেহারা বা ধর্মের পরিবর্তন না করলে সুইডেনে থাকা যাবে না বা কেউ চাকরি পাবে না। এখানে সবারই সমমানের ন্যায্য অধিকার রয়েছে তার ধর্মের উপর বেস্ট প্রাক্টিস করার।

আমি সেই প্রায় ত্রিশ বছর আগে বিয়ে করেছি এখানে। আমার স্ত্রীর বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কখনও আমাকে বলেনি যে খ্রীষ্টধর্মী হতে হবে। তবে আমার বাবা-মা প্রথমেই বলেছিলেন বিবাহবন্ধনে যেকোনো একটি ধর্ম গ্রহণ করতে হবে এবং সেটা ইসলাম ধর্ম হতে হবে। সবাই খুব সহজেই রাজি হয়ে গেল, বিষয়টি আমার মার কাছে অন্যরকম মনে হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, বাবা তুই এদের দেশে থাকিস, এরা সবাই খ্রীষ্টধর্মী, ভেবেছিলাম তোকেই ওরা বরং বলবে খ্রীষ্টান হতে। কিন্তু কোনো বাঁধা ছাড়া মেয়ের বাবা-মাসহ সবাই কী সুন্দরভাবে মেনে নিল। আমার মা পরে মারিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তুমি আমার ছেলেকে ভালোবাসো বলেই কি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে নাকি অন্য কিছু?” উত্তরে মারিয়া বলেছিল সেদিন আমার মাকে, “মা, আমাদের এখানে স্কুলে সব ধর্ম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমার ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি সব ধর্মের উপর খ্রীষ্টধর্মের মতো জ্ঞান রয়েছে। আমি যদি দেখতাম ইসলাম ধর্মে এবং তোমার ছেলের আচরণে কোনো সমস্যা তাহলে এমনটি সিদ্ধান্তে আসতাম না। তারপর তোমার ছেলে যেমন বাংলাদেশ ছেড়ে সুইডেনে পড়াশুনো করতে এসেছে নতুন কিছু জানতে এবং শিখতে। আমারও ঠিক তেমনি একটি চমৎকার সুযোগ হলো তোমাদের সবকিছু শেখা এবং জানার।”

আমার বাবা-মা অনেক বছর সুইডেনে আসা যাওয়া করেছেন। সুইডিশ আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মিশেছেন। আমাদের দুই দেশের মধ্যের সম্পর্কে একটি ভালোবাসার সেতু তৈরি হয়েছে। যে সেতু সামান্য বাতাসে নড়বে না কারণ সেটা মজবুত করে তৈরি করা হয়েছে আত্মবিশ্বাসের উপর, জোর জুলুম করে নয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে যে জিনিসগুলো বেশি নজরে পড়ছে সেটা হলো ধর্মকে সামনে রেখে নানা ধরণের আক্রমণ, ধর্ষণ পরে হত্যা এবং সবশেষে সেটা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া।

ধর্মের বিষয়টিকে সামনে এনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও দেখা যাচ্ছে সেটাকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হামলার শিকার এবং লাঞ্ছিত করা হয়েছে। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে তার বিরুদ্ধে জনগণকে খেপিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকের ধারণা ইসলামের অবমাননা যদি কেউ করে তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে সব কিছু তছনছ করতে হবে। ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে এতবড় কথা? এ সহ্য করা চলবে না।

বাংলাদেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে খুব জোরালো আকারে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ধর্মীয় অবমাননার কথা বলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এরকম হামলা বিভিন্ন সময় হচ্ছে।
আমাদের দেশের ক্রিকেট খেলোয়াড় উচ্চাভিলাষী, পরিশ্রমী, সাকিব বা মাশরাফি এরা জানে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এ বিশ্বাস আমার আছে। কারণ লাখো লাখো মানুষের সামনে এদের সিদ্ধান্তে জয় বা পরাজয় হয়েছে খেলার মাঠে। আমাদের কাজ যাচাই করা, জিতলে হিরো হারলে জিরো। জিতলে বন্ধু হারালে শত্রু। কিন্তু খেলাধুলায় জয় এবং পরাজয় দুটোই রয়েছে। যে ওপরে ওঠে তাকে অনেক ঝড়-ঝাপটা পোহাতে হয়। অনেক রকম ফাঁদ ও প্রলোভন সামলাতে হয়। অনেক সময় বাধ্য হয়ে কৌশলগত কারণে অনেককিছু করতে হয়। এসব কথা ভাববার সময় কি আমাদের আছে?

যে দুর্দশার মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশ, তা থেকে সেরা খেলোয়াড় কেন কেউই রেহাই পাবেনা। আমরা সিনেমায় সুপারম্যান দেখেছি তারাও কী পারবে আমাদের পরিবর্তন আনতে? কারণ পরিবর্তন শুধু নিজ নিজ জায়গা থেকে আনা সম্ভব। সাকিবের যে বিচ্যুতিগুলো দেখছি, সেগুলো কি সমাজের জন্য খুবই জঘন্য? দেশের সুস্থ পরিস্থিতিতে যদি এমনটি হতো, তাহলে কী হতো তাকি আমরা কল্পনা করতে পারি? সাকিবের প্রতি যেসব বাজে মন্তব্য বা হুমকি প্রকাশ্যে করা হচ্ছে এগুলো না হয় আমরা জানতে পেরেছি কিন্তু যে হুমকিগুলো আড়াল থেকে দেয়া হচ্ছে তা কি জানি?

জনগণের জীবনের নিশ্চয়তা দেবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং আমাদের সবার। এখন সরকার এবং জনগণ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবার ফলে আগলে রাখা, পরামর্শ দেওয়া এবং অস্থিরতার মোকাবেলা করার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। শুধু সমালোচনা চলছে, কিন্তু যে বাস্তবতার মধ্যে আমরা আছি, সেটাকে কীভাবে এড়িয়ে চলা সম্ভব তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। কে কখন কী করছে, কার জন্য করছে বা কোন চাপে করছে তা কি আমরা জানি? না জেনে সব বিষয়ের উপর ধর্মকে ব্যবহার করা কি ঠিক হচ্ছে?

সরকারের কাছে উন্নয়নের সংজ্ঞা কী তা যেমন জনগণ জানেনা, আবার জনগণের কী দায়িত্ব তার দেশের উপর তাও অনেকে জানে না। পদ্মা সেতু আর জিডিপির বিতর্কিত সংখ্যার মধ্যে সরকার যেমন উন্নয়নের ভাবনা সীমাবদ্ধতা রেখেছে তেমনি জনগণ ভোট দিতে পারেনি সে কারণে সরকারের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিব্যি খেলা দেখছে। জনগণ, সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কথায় সেটাই লক্ষ্যণীয়।

একটি উন্নত দেশ বলতে যদি সুইডেনের কথা বলি এদের শিল্প-কারখানার প্রসার, জনগণের আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদির সাথে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কথাটি যুক্ত। যার ফলে উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলোর পাশাপাশি এ দেশের মানুষের মগজেরও উন্নয়ন হচ্ছে।  একটি দেশ বা জাতির উন্নয়ন বলতে শুধু গুগল থেকে সব তথ্য দেশের পরিকাঠামোর উপর পেস্ট করে রাখলে হবে কি দেশের পরিবর্তন? তার জন্য সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। ঠিক একইভাবে ধর্মকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে হলে রাম দাও দিয়ে একজন জাতীয় খেলোয়াডের গলা কাটতে চাইলে হবে কি ইসলাম ধর্মকে শান্তির ধর্ম হিসেবে বিশ্বে তুলে ধরা?
আমাদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যেতে হবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে হবে, বেকারত্ব দূর করতে হবে। নতুন প্রজন্ম কি শুধু ইয়াবা, ধর্ষণ, রামদাও এসব কুকর্মের সাথে জড়িত নাকি সুশিক্ষার মধ্যদিয়ে নিজেকে গড়ার কথা ভাবছে? নতুন প্রজন্মকে অদৃশ্যের পিছে না লাগিয়ে দৃশ্যের পিছে লাগাতে হবে। বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বলে জনমত কিংবা বাহুর শক্তি প্রদর্শন না করে বাক স্বাধীনতার চর্চা করানো শিখাতে হবে।

আল্লাহ পাক হজরত মুহম্মদ (সাঃ)কে দুনিয়ার মানুষকে এক করতে বা এক ধর্মে আনতে বলেন নি। তিনি বলেছিলেন বার্তা পৌছে দিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কিংবা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে আমাদের বা একটি দেশের জন্ম হয়নি।কিন্তু হতাশার বিষয়, যে কারণে মানুষ জাতির জন্ম হয়েছে তা পালন না করে আমরা ভন্ডামি আর গুন্ডামি করে চলছি।
আমরা ১৯৭১ সালে যে দলের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছি সেই দলটি গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরেও পরিবর্তন আনতে পারছে না। যে বিষয়গুলোর উন্নয়ন হবার কথা তা হয়নি বরং ঘটে চলেছে ধারাবাহিক পতন।
বর্তমানে অনেকের মুখে একটাই কথা কিভাবে দেশের বাইরে চলে যাওয়া যায়। এর জন্য তারা পরামর্শ চায়, কীভাবে নিজ দেশ ছেড়ে পশ্চিমা দেশে আসা সম্ভব।

বাংলাদেশের তরুণদের ৮৮ ভাগ দেশের বাইরে স্থায়ী হতে পাগল। এটাই যদি বাস্তবতা হয় তাহলে অন্য ধর্ম বিশ্বাসীদের উপর ঘৃণা জন্মানো কি ঠিক? এখানকার মানুষ আমাদের মতো ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী না এবং এখানকার সবই হারাম, এটাই যদি ঘটনা হয় তাহলে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে এখানে বসবাস করা এবং এখানকার অর্থ দেশে পাঠানো (সবই যখন হারাম) বিষয়টি কেমন হয়ে গেল না?  আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ ভাগই তরুণ এবং এদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। কেন তারা দেশ ছাড়তে প্রস্তুত? কারণ, নিরাপত্তার অভাব, বেকার সমস্যা, দুর্নীতি, অনীতিসহ আরও বেশ কয়েকটি বিষয় জড়িত।

পরিতাপের বিষয় হলো, দেশকে সোনার বাংলা করার কথা কেউ এখন ভাবছে না। এ নিয়ে দেশের কারও ভাববার সময় নেই। ধামাচাপা দেয়ার রেওয়াজ, গলাবাজি, অসত্য তথ্য দিয়ে আর কেবলমাত্র ইটপাটকেলের উন্নয়ন দেখিয়ে মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া যায়, জনগণের সার্বিক উন্নয়ন এবং তাদের মগজের কী অবস্থা তা কি আমরা সত্যিকারার্থে জানি বা জানতে আগ্রহী?

লেখক: রহমান মৃধা
সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বাণিজ্যিক বিবেচনায়  ‘সৌরবিদ্যুৎ’ টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক
কক্সবাজার: বাংলাদেশে অফুরন্ত পর্যটন সুযোগ উন্মোচন
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
ওএসডি কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে
নেট দুনিয়ার ব্যাংকিং
সর্বজনীন কল্যাণে ইসলামী ব্যাংক: আন্তরিক সেবার ৪০ বছর
সুইডেনের ইনফ্লেশন ১২ শতাংশ, গোল ২ শতাংশ
ব্যাংকের নাম: লিমিটেড থেকে পিএলসি