রিজার্ভ থেকে এ তহবিলের আওতায় বছরে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে। সুদের হার হবে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ। এর বাইরে অন্য কোনো ফি বা চার্জ আদায় করা যাবে না। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণের বিকল্প উৎস হিসাবে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো এ ধরনের তহবিল গঠন করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া এমনকি বিশ্বে এ ধরনের তহবিল গঠন এটাই প্রথম।
সোমবার (১৫ মার্চ) আনুষ্ঠানিকভাবে তহবিলের কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন। একই সঙ্গে প্রথম দিনে সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া উন্নয়ন প্রকল্প পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ড্রেজিং প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার বিষয়ে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ চুক্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ও স্বাক্ষর করেছে।
তিন বছরের মধ্যে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে এ ঋণ দেওয়া হবে। এ তিন বছর থাকবে গ্রেস পিরিয়ড। অর্থাৎ ঋণের বিপরীতে কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। তিন বছর পর থেকে কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। পরের সাত বছরের মধ্যে এ ঋণ সুদসহ শোধ করতে হবে। ঋণের মোট মেয়াদ হলো ১০ বছর। তবে ঋণের মেয়াদ পরে বাড়ানো হবে কি না, এ বিষয়ে চুক্তিতে কোনো উল্লেখ নেই। ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য সোনালী ব্যাংক একটি কমিশন পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকল্পের সম্ভাবনা ও ঝুঁকি তদারকি করবে। সূত্র জানায়, এ তহবিল থেকে ঋণ পেতে হলে সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প হতে হবে। এর বিপরীতে সরকারের গ্যারান্টি দিলে তবেই ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবে। প্রকল্পকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে হবে। দেশি-বিদেশি যেসব উদ্যোক্তা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে, তাদের এ প্রকল্প থেকে ঋণ দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে বাস্তবায়নের বৈদেশিক মুদ্রার জোগান উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ হিসাবে অর্থায়ন করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করতে এর তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিষয়াদি পর্যালোচনাসহ দেশের সম্ভাব্য আমদানি ও অন্যসব বৈদেশিক দায় পরিশোধের সক্ষমতা সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকির বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।
দেশের বর্তমান রিজার্ভ ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার হলেও মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে উত্তরণকালে এটি পর্যাপ্ত কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বাংলাদেশকে পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে উন্নীত করতে ব্যাপক হারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন এবং বৈদেশিক দায় পরিশোধের সক্ষমতার মানদণ্ড হিসাবে দেশে স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সার্বক্ষণিকভাবে বজায় রাখা জরুরি।
বেশি রিজার্ভ থাকলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হয়। এ কারণে ছয় মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ সব সময় রাখতে হবে। যদিও আইএমএফের নিরাপদ মাত্রার জন্য তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ থাকলেই চলে। বর্তমান যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
এতে আরও বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও বিশেষ বিবেচনায় শুধু সরকারের কৌশলগত অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রকল্পে সরকারি গ্যারান্টির বিপরীতে অর্থায়ন করা হবে। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্পের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে গৃহীত ঋণের সুদহার আপাতত দৃষ্টিতে কম মনে হলেও এসব ঋণের ক্ষেত্রে প্রায়ই উন্নয়ন সহযোগীদের কথামতো পরামর্শক নিয়োগ, সুদ ছাড়া নানা ধরনের ফি ও চার্জ আরোপ, অনুপযুক্ত প্রযুক্তি ও পণ্য ক্রয়সহ অন্যসব অস্বস্তিকর শর্তারোপের বাধ্যবাধকতায় পড়তে হয়। ফলে প্রকৃত ঋণ ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এসব দিক বিবেচনায় সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণের বিকল্প উৎস হিসাবে রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগ করলে সুফল মিলবে।
জানা যায়, বর্তমানে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ। এর সঙ্গে রয়েছে নানা শর্ত। রিজার্ভ থেকে ঋণ নিলে এসব শর্ত থাকছে না। স্বাধীনভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এতে খরচ কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি ঋণের বিকল্প হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কয়েকটি তহবিল রয়েছে। এর মধ্যে রপ্তানি খাতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ৫০০ কোটি ডলার, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন প্রকল্প ৩৫০ কোটি ডলার, সবুজ কারখানায় রূপান্তর তহবিল ২০ কোটি ডলার ও ২০ কোটি ইউরো তহবিল রয়েছে। এসব তহবিল থেকে স্বল্প সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এর আগে রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ বিমানকে ৩০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।