পুঁজিবাজারে কখন এবং কেন বিনিয়োগ করবো?
সাধারণত কোনো সফল বিনিয়োগকারীর যদি আমরা ইতিহাস দেখি, যেমন ওয়ারেন বাফেট একজন সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে সারা বিশ্বে সমাদৃত, শেয়ার মার্কেট থেকে তিনি পৃথিবীর অন্যতম সফল শ্রেষ্ঠতম সম্পদশালী ব্যক্তি হয়েছেন। কিন্ত কিভাবে? তিনি নিজে বলেছেন যখন পুঁজিবাজারে ধস নামে, যখন বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেয়, তখন ওয়ারেন বাফেট ভালো ভালো ফান্ডামেন্টাল শেয়ার অত্যন্ত কম দামে কিনেন এবং দীর্ঘদিন ধরে রাখেন। পুঁজিবাজারের ধর্মই হলো, যে কোনো ভালো শেয়ার যদি কোনো বিনিয়োগকারী সঠিক সময়ই কিনে ফেলতে পারেন এবং দীর্ঘদিন ধরে রাখার সামর্থ অর্জন করেন। তাহলে ২/৪ বছরের মধ্যে সেই শেয়ার বিক্রি করে বিশাল পরিমানে ক্যাপিটাল গেইন করেছেন। আমি আমার একটি বিনিয়োগ অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
১৯৯৬ সালে শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি হচ্ছিলো, ওইসময় শুধু একটি শেয়ারের কথা বলব, যেটি আমার কাছে ছিল। সেই শেয়ারটির নাম ছিল চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকার গ্র্যান্ডিং ফ্যাক্টরি। শেয়ারটি আমার কিনার অ্যাভারেজ প্রাইস ছিল ১২০০ টাকা, আমি এই শেয়ারটি কিনার সময় সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা লোন নিয়েছিলাম, অন্যান্য ব্যাংক থেকেও আমি বিভিন্ন শেয়ার কিনার জন্য লোন নিয়েছিলাম। এই শেয়ারটির দাম উঠেছিল সর্বোচ্চ ১৪০০০ টাকা। তবে শেয়ারটির দাম যখন ১১,৫০০ টাকা করে চলছিলো তখন ইচ্ছা করলেই শেয়ার পাওয়া যেতোনা। আমাদের একজন মেম্বার তখন ১১,৫০০ টাকা দিয়ে কিছু শেয়ার কিনেছিলো। আমি তার থেকে অনেক অনুরোধ করে এই দামে ৫০০ শেয়ার নিয়েছিলাম৷ ওইসময় আমাদের একজন মেম্বারের নাম বলতে হয়, তার নাম হলো শাহ মোহাম্মদ সগীর, তিনি আমাদের মাঝে নাই, এই নামটি এই জন্যই আনলাম, তখন বাজারে একটি কথা প্রচলন ছিল শাহ মোহাম্মদ সগীর যেই শেয়ার ধরবে সেটাই বাড়বে। অবশ্যই শাহ মোহাম্মদ সগীরের কথায় আমিও কিছু শেয়ার কিনেছিলাম।
আরেকটি কথা বলতে হয়, ওইসময়ে আমাদের একজন মেম্বার আমার কাছে এসেছিলেন বাজার পরিস্থিতি বুঝার জন্য এবং কিছু উপদেশ নেয়ার জন্য। তিনি বললেন রকিব ভাই আমার কাছে অনেক এপেক্স ফুডের শেয়ার আছে। তখন এইটার বাজার মূল্য ছিল ১৮,০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকা। তিনি জানতে চাইলেন আমি এখন শেয়ার বিক্রি করবো না ধরে রাখবো। আমি চিন্তা করে দেখলাম এই মুহূর্তে বিক্রি করার কথা বললে কেউ বিক্রি করবে না। তখন আমার মাথায় জাস্ট একটা আইডিয়া আসলো। আমি উনাকে বললাম যে আপনি একটা কাজ করতে পারেন। অর্ধেক শেয়ার বিক্রি করে দেন আর বাকি অর্ধেক শেয়ার রেখে দেন। তাতে আপনার দুই দিকে উপকার হবে। প্রথম উপকার হবে, অর্ধেক শেয়ার বিক্রি করার পর যদি শেয়ার এর দাম কমে যায়, তবে আপনি আপসোস করবেন না। কারণ আপনি অলরেডি ভালো দামে অর্ধেক শেয়ার বিক্রি করেছেন। আর যদি দাম বাড়ে তবে আপনার কোনো আপসোস থাকবে না। কারণে অর্ধেক শেয়ার আপনার হাতে আছে।
আমি কি করলাম?
তখন আমার হাতে থাকা ১২ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছি। এর বিপরীতে ১০ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছি। কিন্তু চিটাগং ক্লিঙ্কারিং এর একটি শেয়ারও বিক্রি করিনি। একেবারেই বুঝতে পারিনি, বাজারে কোনো বড় ধরণের ধস নামবে। ১৯৯৬ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বড় ধরণের ধস নামা শুরু হয়েছিল। বিনিয়োগকারীসহ আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম। প্রতিদিন শেয়ারের দাম পড়তে থাকলো। কিন্ত কেনো জানি আমার একটি দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বাজার অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্ত আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল হয়ে চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকারের দাম ১৪০০০/১৫০০০ হাজার থেকে নেমে ৫০০ টাকায় চলে আসলো। যা আমার অ্যাভারেজ প্রাইসের অনেক কম। এরপর আমি যে সিদ্ধান্তটি নিলাম, আজকের এই পরিস্থিতিতে সকল বিনিয়োগকারীকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করবে।
প্রথমত আমি দেখলাম, বাজার যখন চুড়ান্ত ক্রাশ করলো তখন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আমরা যারা লোন নিয়েছিলাম, সেই লোনের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ শুরু করলো। আমার তখন শেয়ারের দাম যেটা সর্বোচ্চ ২৩ কোটি টাকা ছিল। এক সময় তা কমে ৬ কোটি টাকার নিচে চলে এলো। অপরদিকে আমার ব্যাংক লোন প্রায় ৬ কোটি টাকার কাছাকাছি। আমি ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সচেষ্ট হলাম এবং আমি চিন্তা করলাম কোনো অবস্থাতেই আমি কোনো শেয়ার বিক্রি করবো না। এখান থেকে আমি সচেষ্ট হলাম। কিছু টাকা দিয়ে আমার ব্যাংক লোন ২ বছরের জন্য রি-সিডিউল করার জন্য মুভ করলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম এই শেয়ারগুলো ফান্ডামেন্টাল হওয়ায় যদি দুই-তিন বছর ধরে রাখতে পারি, এখান থেকে আমি বিক্রি করে লাভ না করতে পারলেও অন্তত লোনের টাকা শোধ করতে পারবো৷ কিন্ত তখন ব্যাংক লোনের ইন্টারেস্ট অনেক উচ্চ ছিল এবং চক্র বৃদ্ধি হরে ইন্টারেস্ট বাড়ছিল ।
উল্লেখযোগ্য যে, চিটাগং সিমেন্ট ক্লিংকারের শেয়ারের দাম যখন উচ্চ প্রাইসের দিকে যাচ্ছিলো, তখন ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের জন্য ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছিলো ৫০% বোনাস এবং ৫০% রাইট৷ এতে করে আমি উপকৃত হয়ে গেলাম৷ আমার ১২০০০ শেয়ার ২৪০০০ হলো এবং আমার এভারেজ প্রাইসও কমে গেলো। আমি দেখলাম ২, ৩ বছরের মাথায় আমার চিটাগাং সিমেন্ট ক্লিংকারের শেয়ারের দাম আমার এভারেজ ক্রস করে লাভ চলে আসলো৷ ঠিক একইভাবে অন্যান্য ভালো শেয়ারগুলো আমার এভারেজ প্রাইসের উপরে উঠতে থাকলো৷ আর যত বাজে শেয়ার ছিলো সবগুলো পড়তে থাকলো৷ তখন আমি আর দেরি না করে সিদ্ধান্ত নিলাম লাভের আর দরকার নাই৷ আমাকে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে হবে, আমি আর লোভ না করে ক্রমান্বয়ে ভালো ভালো শেয়ারগুলো বিক্রি করে সকল লোন পরিশোধ করে দিলাম এবং ঋণ মুক্ত হলাম, সাথে কিছু টাকাও পেলাম৷
ফলে আপনি কোনো ভালো শেয়ারে যদি দীর্ঘ মেয়াদে থাকতে পারেন, তাহলে অন্তত আপনার লস হবে না। আরেকটি জিনিস অনুভব করলাম, আমি তখন পুঁজিবাজারে ছোট খাটো একজন নেতা, সারাক্ষণ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের একজন পরিচালক হিসেবে বক্তব্য দিতাম৷ আমার বড় সান্তনা আমি আমার বিনিয়োগকারী ভাইদের উপর আনজাস্টিফায়েড প্রাইসে কোনো দিনও কোনো শেয়ার বিক্রি করিনি৷ মহান আল্লাহর কাছে এইজন্য হাজার শুকরিয়া৷ আর যে মেম্বার ভাইটিকে আমি এপেক্স ফুডের বাপারে যে পরামর্শ দিয়ে ছিলাম, তিনি কিন্তু একটি শেয়ারও বিক্রি করেন নাই। লোভে পড়ে বা উচ্চ দাম পাওয়ার আসায়৷ পরবর্তীতে উনি বড় ধরনের লস করেছিলেন৷ আরেকটি উদাহরণ এখানে আনতে পারি, আজকের এনসিসি ব্যাংক সেই সময় একটি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ছিলো। তখন ১৯৯৪, ৯৫, ৯৬ এ ব্যাংকটি থেকে অনেক ভালো ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিল এবং আমাদেরকেও বিনিয়োগে ঋণ দিয়েছিল৷ তারাও বাজার যখন উচ্চ দামে ছিল, তখন শেয়ার বিক্রি করে নাই। পরবর্তীতে দর পতনের সময় তারা তাদের শেয়ার বিক্রি না করে ধরে রেখেছিলো৷ দুই চার বছরের মধ্যে যখন ভালো শেয়ারের দাম বাড়া শুরু হল, তখন তারা ধীরে ধীরে শেয়ার বিক্রি করে প্রচুর লাভ করেছিল৷ ওই লাভের টাকা দিয়ে তারা পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক এনসিসি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন৷ এটাও বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকে ভাল শেয়ারে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে ৷
এবার মূল বিষয়ে আসি, সার্বিক করোনাভাইরাসকে (কোবিড ১৯) সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এতে কম বেশি সব দেশেরই অর্থনৈতিক মন্দা, কলকারখানা বন্ধ, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি সব খাত কম বেশি স্থবির৷ আইএমএফ প্রধান বলেছেন করোনাভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবীর অর্থনীতির মন্দাভাব চলতে থাকবে। এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বাহিরে না৷ তবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে, কোন দেশ কত দ্রুত তার আর্থিক সংকট কাটিয়ে, কে কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে? আমি বিশ্বাস করি, ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ পৃথিবীর কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি হবে, যে দেশ মন্দা দ্রুত কাটিয়ে উঠবে৷ এখন এই মুহূর্তে বিভিন্ন বিনিয়োগকারী, কি কি বিবেচনায় এনে কোন কোন শেয়ারে বিনিয়োগ করবে৷ কোনটা দীর্ঘমেয়াদি করবে, অথবা কোনটা স্বল্পমেয়াদি করবে (স্বল্পমেয়াদি বলতে ন্যূনতম ৬ মাস)। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উভয় ক্ষেত্রে দেখতে হবে করোনাভাইরাসের কারণে কোন কোন লিস্টেড কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং কোনগুলো হয়নি৷ যেমন এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড গার্মেন্টস, সেগুলোর ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। কারণ এক্সপোর্ট অর্ডারগুলো বন্ধ হয়ে গেছে৷ তাতে করে এই লিস্টেড কোম্পানিগুলো সামনে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে৷ দ্বিতীয়ত যারা আমদানি করে ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যবসা করছেন, তারাও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন৷ এই দুইটাকে বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে৷ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী যারা ডে ট্রেডিং এ অভ্যস্ত তাদের প্রতি আমার কোনো সুপারিশ নেই৷ শুধুমাত্র সুপারিশটি হলো যে সকল বিনিয়োগকারী ফান্ডামেন্টাল দেখে, কোম্পানির গ্রোথ দেখে, রিজার্ভ দেখে, বিগত ৫ বছরে লভ্যাংশ প্রদান বিচার বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করে। তাদের প্রতি বিনিয়োগে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমার সুপারিশ৷ যারা সার্কুলার ট্রেডিংয়ের প্রভাবলে শেয়ার কিনে অথবা গুজবের ভিত্তিতে শেয়ার কিনে অথবা নিজেরা কোনো বিচার বিশ্লেষণ না করে শেয়ার কিনে তাদের প্রতি আমার কোনো সুপারিশ নেই৷
কোন শেয়ারে বিনিয়োগ করবো?
লিস্টেড কোম্পানির মধ্যে এমন কিছু শেয়ার আছে, যেগুলো করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্থ না। যেমন পাওয়ার সেক্টর, গ্যাস এবং ইলেকট্রিকাল ট্রান্সমিশন সেক্টর অথবা ফার্মাসিউটিকাল সেক্টরস। যেগুলো এইমুহূর্তে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কথা না৷
যখন একটি দেশের অর্থনৈতিক মন্দা চলতে থাকে, তখন কিন্ত প্রাইভেট সেক্টর দুর্বল হয়। আর পাবলিক সেক্টর মানে সরকার এগিয়ে এসে বড় বড় প্রজেক্ট করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য৷ সব দেশের সরকার যখন এই কার্যক্রমগুলো শুরু করে শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের জন্য, তখন কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিগুলো (রড, সিমেন্ট, বালু) উপকৃত হয়৷ একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে প্রত্যেকটি অবস্থানকে বিশ্লেষণ করে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের অবস্থান সুযোগ হয়েছে৷ বিশেষ করে আমি প্রথম বলবো, ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন যাদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংক সহজ শর্তে বিনিয়োগের জন্য যে ২০০ কোটি টাকা দিয়েছেন, তাদেরই প্রথম উদ্যোগটা নিতে হবে৷ যেহেতু এই ২০০ কোটি টাকা ৫ বছরের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছেন৷ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক্সপার্ট বা এনালিস্টরা সরকারের দেয়া ২০০ কোটি টাকার সুযোগ নিয়ে যদি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেন, তাতে অবশ্যই লাভবান হবেন এবং পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে বড় ধরণের ভূমিকা রাখতে পারবেন৷ করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক মন্দা বেশি দিন হবে না ইনশাআল্লাহ৷
বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু সুপারিশ
আমরা যারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে থাকি, তারা অবশ্যই বিনিয়োগ করে বসে আছি৷ কিন্তু অনেক বড় বিনিয়োগকারী আছেন, যারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। আমাদের সবার জন্য একটি সুযোগ আছে, যেমন আমি যে শেয়ারগুলো কিনেছি, সেই শেয়ারগুলো দাম অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মূল্য একেবারে তলানিতে। যদি আমার কাছে টাকা থাকে আমি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ফান্ডামেন্টাল দেখে কিছুটা অ্যাভারেজ করতে পারি। মার্কেট বন্ধের আগে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগ করে আমি সুফল পেতে যাচ্ছি। এর একমাত্র কারণ হলো আইনের মাধ্যমে সকল লিস্টেড কোম্পানিকে বাধ্য করা হচ্ছে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়ার জন্য। ইতিমধ্যে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নগদ ও বোনাস ঘোষনা করেছে৷ আমরা আশা করি অন্যান্য ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এইমুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নগদ লভ্যাংশ ঘোষনা করবে৷ অপরদিকে আমি মনে করি লিস্টেড যতগুলো ভালো ভালো কোম্পানি আছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ স্ব স্ব কোম্পানিতে যারা উদ্যোক্তা পরিচালক আছেন, তাদেরকে অনুরোধ করবো এই পর্যায়ে আপনাদের কোম্পানিতে শেয়ারের দাম সবনিম্নে আছে, এটাও আপনাদের জন্য শেয়ার কিনার একটি বড় সুযোগ৷ যেহেতু বাই ব্যাক আইন আমাদের দেশে নাই, সেহেতু ভালো ভালো কোম্পানি স্ট্রং রিজার্ভ থেকে শেয়ার কিনতে পারছে না৷ মাননীয় অর্থমন্ত্রী লিস্টেড কোম্পানি বাই ব্যাক আইন করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। আশা করি এই আইন বাস্তবায়ন হলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের পুঁজিবাজার উপকৃত হবে এবং বিনিয়োগকারীও উপকৃত হবে৷ সবদিক বিবেচনা করে নিজেদের অভিজ্ঞতা খাটিয়ে আশাকরি বিনিয়োগকারীরা হতাশ না হয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগে থাকবেন৷ আবেগকে কোনো দাম দিবেন না৷ কোনো প্রকার সার্কুলার ট্রেডিং ও ম্যানিপুলেশন এর সাথে জড়িত থাকবেন না, লোভ নিয়ন্ত্রন করবেন৷ কারণ রাতারাতি পুঁজিবাজার থেকে টাকা কামিয়ে বড়লোক হবার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হবে৷
সবদিক বিচার বিবেচনা করে পুঁজিবাজারের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সবাইকে সবার অবস্থান থেকে কিছু কাজ করতে হবে৷ মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে আমি অনুরোধ করবো, লিস্টেড কোম্পানি বাই ব্যাক আইনটি জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর করার জন্য৷ যেসকল লিস্টেড কোম্পানি করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদেরকে স্বল্প সুদে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি সুশাসনের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য৷ যখন আর্থিক মন্দা চলে তখন প্রাইভেট সেক্টর দুর্বল হয়ে পড়ে৷ প্রচুর বেকার সমস্যার সৃষ্টি হয়৷ কনস্ট্রাশন কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হয়৷ এইসময় সরকারের উদ্যোগে বড় বড় প্রজেক্টে কাজ শুরু হলে আবার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে৷ মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে আমি অনুরোধ করবো, লিস্টেড কোম্পানিগুলোর কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে দেয়ার জন্য৷ তাতে করে লিস্টেড কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের ভালো ডিভিডেন্ড দিতে পারবে৷ শুধু একটি কথা এখানে বলতে চাই, একই পণ্য উৎপাদনকারী একটি লিস্টেড কোম্পানি এবং নন লিস্টেড কোম্পানি দুই রকমের ট্যাক্স দেয়। লিস্টেড কোম্পানিকে একটি স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য অডিটেড অ্যাকাউন্টস তৈরির মাধ্যমে ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু একটি নন লিস্টেড কোম্পানির তেমন কোনো জবাদিহিতা থাকে না৷ সমপরিমানের উৎপাদন এবং বিক্রয়ের পরেও লিস্টেড কোম্পানি বেশি পরিমানের ট্যাক্স দিয়ে থাকে৷ কারণ লিস্টেড কোম্পানির ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার তেমন কোনো সুযোগ নাই। ওই কোম্পানিকে কিছু ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টসের আইন মেনে কাজ করতে হয় এবং প্রতি তিন মাস পর পর তাকে কোম্পানির সর্বশেষ অবস্থা বিনিয়োগকারীকে জানাতে হয়৷ অপরদিকে নন লিস্টেড কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগ নিজেদের প্রয়োজন মতো অ্যাকাউন্টস তৈরী করে৷ সেহেতু কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না৷
পুঁজিবাজারের স্বার্থে যে যেখানে আছি, আমাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে কাজ করতে হবে৷ করোনাভাইরাস আতঙ্ক অর্থনৈতিক দীর্ঘমেয়াদি মন্দার সম্ভাবনা সামনে রেখে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে কিছু কিছু ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ভূমিকা পালনের অনুরোধ করছি৷ যে সকল কোম্পানির পরিচালকদের সম্মিলিত ৩০% শেয়ার নেই এবং এককভাবে ২% শেয়ার নেই, তাদেরকে আইনের আওতার মধ্যে এনে বাধ্য করতে হবে ৩০% শেয়ার পূরণ করার জন্য৷ কোনো লিস্টেড কোম্পানি যেনো কোনো ধরণের অনিয়ম করতে না পারে, এজন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে৷ নতুন আইপিও দেয়ার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে অথবা প্রিমিয়াম দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরণের যাচাইবাছাই করতে হবে৷ অ্যাকাউন্টস ও অডিট রিপোর্ট, প্রসপেক্টাসে ১০০% স্বচ্ছতা থাকতে হবে৷ বিশেষ করে ক্যাপিটাল বৃদ্ধিতে যারা টাকা ঢুকায়, উৎপাদন এবং গোডাউনে সংরক্ষিত মাল এবং জমির মূল্যের ক্ষেত্রে সন্দেহ থাকলে ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন করতে হবে৷ ক্যাপিটাল বৃদ্ধিতে যে টাকা ঢুকানো হচ্ছে, সেই টাকার উপর ট্যাক্স দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে৷ পুঁজিবাজারে আসার আগে কোনো কোম্পানি রাতারাতি যদি সন্দেহজনক কোনো ক্যাপিটাল বৃদ্ধি করে অথবা উৎপাদন বৃদ্ধি পায় অথবা বিক্রি বেড়ে যায় অথবা গোডাউনে অতিরিক্ত তৈরী মাল থাকে, সেখানে আমাদেরকে সত্যতা দেখতে হবে। পুঁজিবাজারে সার্কুলার ট্রেড এবং ম্যানুপুলেশন কঠোরভাবে দমন করতে হবে৷ যে যত বড়ই হোক আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে৷ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজারের কোনো বিকল্প নেই৷ পারিবারিকভাবে পরিচালনা করে এমন বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে আনার জন্য উৎসাহিত করতে হবে৷ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে তাদেরকে সম্পূর্ণ ফান্ডিং বন্ধ করতে হবে৷
সরকারের হাতে থাকা লাভজনক ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাননীয় অর্থমন্ত্রী কাজ শুরু করেছেন। সেটা ত্বরান্বিত করতে হবে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকেরও সহযোগিতার হাত এগিয়ে আনতে হবে৷ পুঁজিবাজারে সরকারের পক্ষ থেকে ২০০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছে৷ এই টাকাটি যেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহজভাবে নিতে পারে এবং বিনিয়োগ করতে পারে তার সুযোগ করে দেওয়া৷
লেখক : মো: রকিবুর রহমান
সাবেক সভাপতি এবং বর্তমান পরিচালক
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড (ডিএসই)