সেদিন থেকেই আমার জীবনের পরিবর্তন শুরু হয় বাবা-মার অঢেল ভালোবাসা অনুভব করতে পেরে। যে অপরাধ আমি সেদিন করেছিলাম সেটা কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা যাওয়া এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার এত অল্প বয়সে! কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিল যে বাড়ি ছাড়তে হবে?
লেখাপড়ার চেয়ে গান-বাজনা এবং অভিনয়ে শখ ছিল বেশি ছোটবেলা থেকেই। সপ্তাহখানেক আগ থেকেই বাহানা ধরেছি আমি একটি হারমোনিয়াম কিনব। এজন্য ১০ হাজার টাকা লাগবে।
মাকে বললাম, মা, কিছু টাকা লাগবে।
মা বললেন, ড্রয়ারের মধ্যে ৫০ টাকা আছে দেখ।
আমি হা হা করে হাসছি।
মা বললেন কী হলো?
আমি বললাম ৫০ টাকা দিয়ে তো হবে না?
মা বললেন তাহলে নিতে হবে না যা।
মা।
কী?
ও মা।
শুধু মা মা করছিস ক্যান? কাজ করছি, বিরক্ত করিস না।
শোননা মা।
বল শুনছি।
একটি হারমোনিয়াম কিনব।
হারমোনিয়াম কেনা চলবে না এ বাড়িতে।
ক্যান মা?
হারমোনিয়াম বাজলে বাড়িতে ফেরেস্তা আসে না।
কে বলছে এসব কথা?
কে মানে?
তুমি বাবাকে বল এটা আমার চাই।
তা দাম কত?
কাশেম স্যার বলছে ১০ হাজার, তবে আমার কাছে ৫ হাজার আছে।
তুই এত টাকা কোথায় পেলি?
কেন জমিয়েছি, হারমোনিয়াম কিনব বলে।
আচ্ছা বলবো, এখন পড়তে যা।
সুযোগ পেয়ে পড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। কী আর করা! জোরে জোরে পড়তে শুরু করলাম সবাইকে শুনিয়ে।
পড়া শেষে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে আছি।
বাবা খাবার শেষে এশার নামাজে বসেছেন।
নামাজ শেষে মা বলছেন, শুনছো?
কিছু বলবে?
হুম।
বলো?
তোমার ছেলে একটা হারমোনিয়াম কিনবে বলছে। সে নাকি কিছু জমিয়েছে, কিন্তু দাম ১০ হাজার।
ও টাকা পেলো কোথায়?
বললো জমিয়েছে, তুমি ওরে সাত হাজার টাকা দিয়ে দাও।
কিন্তু---
কিন্তু কী আবার?
কিছু বোঝো না? ওটা কিনলে তো লেখাপড়া লাটে উঠবে। মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাবা সোজা বলে দিলেন, হারমোনিয়াম টারমোনিয়াম এ বাড়িতে চলবে না। এ নিয়ে দ্বিতীয় বার আমি কিছু শুনতে চাই না।
আমি রাতে ঘুমোতে পারলাম না। পরের দিন প্লান করলাম বাড়ি থেকে পালাব। মা আমাকে দেখেছে আমি বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠেছি তার পরও জিজ্ঞেস করলেন,
কখন উঠলি?
একটু আগে।
মন খারাপ নাকি?
চুপচাপ রইলাম কোনো উত্তর ছাড়া। পরের দিন রাতে টাকা-পয়সা আর মার সোনা যা ছিল সব নিয়ে ভোর রাতে ঢাকার পথে রওনা দিলাম।
আমি পরিবারের চার নম্বর সন্তান। আমার বড় তিন ভাই, একজন উচ্চশিক্ষার্থে ইউরোপে, একজন বিএমএ ট্রেনিংরত, তৃতীয় জন সম্ভবত খুলনা বিএল কলেজে। বাকিরা আমার ছোট এবং সবাই গ্রামের বাড়িতে। সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে কষ্ট লাগছে তারপরও যেতে হবে। রাগ এবং জিদ দুটো মিলে আমাকে দুর্দমনীয় করে তুলেছে। পৌঁছে গেলাম ঢাকায়। এ এক নতুন জীবন। এ জীবন সম্পর্কে অতীতে লিখেছি।
বাবা পুলিশের স্পেশাল ব্রান্সে চাকরি করেছেন, স্বাভাবিকভাবেই আমাকে খুঁজে বের করতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। মা ছাড়া এক সপ্তাহ আমি যে কষ্ট পেয়েছি আমাকে ছাড়া মা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কষ্ট পেয়েছে। সন্তান হারানোর জ্বালা মা ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে কেমন করে!
ভেবেছিলাম বাবা খুব রেগে যাবেন, বকাঝকা করবেন কিন্তু কিছুই করলেন না বরং ভয়ঙ্কর রাগী বাবা এমনভাবে পরিবর্তন হতে পারেন যা আমাকে অবাক করে ছিল!
বাবা ঢাকা শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু দেখালেন। তার আগে মাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিলেন আমাকে পেয়েছে।
ঢাকা শহর ছেড়ে বাড়ি আসতে গ্রামের সবাই আমাকে নতুন করে দেখতে এসেছে। এক সপ্তাহে কী এমন মায়া ছড়িয়েছিল আমাকে ঘিরে? আজও তা জানি না তবে ঘটেছিল ঘটনা, যা এখনো মনে পড়ে। বুঝেছিলাম সেদিন প্রথম, ভালোবাসা কারে কয়।
এই ঘটনার পর আমি বাংলাদেশে চার বছর থেকেছি। এসএসসি এবং এইসএসসি শেষ করে সুইডেন পাড়ি দিয়েছি। পরিবারের বলতে গেলে সবাইকে নানাভাবে সাহায্য করেছি প্রতিষ্ঠিত করতে। বাবা-মাকে নিয়ে বিশ্বের নানা দেশ ঘুরেছি। মজা করেছি। সুইডেনে বসবাস সত্ত্বেও আমেরিকান কোম্পানিতে চাকরি করেছি। বাবাকে নিয়ে একবার ক্যালিফোর্নিয়ায় বেড়াতে এসেছি। সেখানে আমার তিন বোনের একজন থাকে।
বাবাসহ আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী মারিয়া এবং ছেলে জনাথান। জনাথানের বয়স তখন চার বছর। লসএঞ্জেলসের আর্টেসিয়ায় কেনাকাটি শেষে ঢুকেছি লাঞ্চ করতে। রেস্টুরেন্টে নানা ধরনের খাবার ব্যুফে আকারে দিয়েছে। জনাথান খাবারের মাঝে হঠাৎ বাবাকে প্রশ্ন করলো, দাদু তুমিও কি আমার বাবাকে সব জায়গা নিয়ে ঘুরেছো যেমনটি আমার বাবা আমারে নিয়ে ঘোরে?
কথাটি শোনার পরে বাবা অবাক না হয়ে কাঁদছেন আর বলছেন, দাদু ভাই আমি তো তোমার বাবার মতো এত বড় চাকরি করিনি, তাছাড়া বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ সেখান থেকে বিশ্ব ঘোরা কখনও সম্ভব নয়।
বাবার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মাত্র চার বছরের একটি ছেলের কথা এত সিরিয়াস নিলেন, আমি নিজেও বেশ অপ্রস্তুত, কিছুই বুঝতে পারছি না। জনাথানই বা কিভাবে হঠাৎ এমন একটি প্রশ্ন করতে পারলো? এদিকে মারিয়া জনাথানকে সঙ্গে সঙ্গে বললো, দাদু তোমার বাবাকে বিশ্ব ঘোরায়নি তবে যাতে করে তোমার বাবা নিজে এবং আমাদের সবাইকে ঘুরাতে পারে সে ব্যবস্থা করেছেন।
জনাথান জিজ্ঞেস করল কীভাবে?
মারিয়া বললো, তোমার বাবাকে সব থেকে ভালো স্কুল, কলেজ এবং বিদেশে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে যার ফলে তোমার বাবা আজ সারা বিশ্ব ঘুরছে।
মাত্র চার বছরের ছেলে মার কথার সত্যতা যাচাই করতে সাথে সাথেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, মা যা বলছে তা-কি সঠিক? আমি বললাম হ্যাঁ বাবা, তোমার মা যা বলছে সেটা সঠিক।
জনাথান এর মধ্যে লক্ষ্য করছে দাদু ভাইয়ের চোখে পানি। সে জিজ্ঞেস করছে দাদু তুমি কি দাদিকে মিস করছ? বাবা উত্তরে বললেন হ্যাঁ ভাই। (প্রসঙ্গত আমার মা তখন সুইডেনে থাকেন। আমেরিকায় আমাদের সঙ্গে আসেননি, মার শরীরটা তখন একটু খারাপ ছিল)।
বাবা-মার ভালোবাসা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা বাংলাদেশ থেকেই জন্মেছে। পরে নিজে বাবা হয়েছি। জীবনের একটি সময় হঠাৎ নিজে অসুস্থ হয়েছিলাম। সময়টি ছিল জীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, পৃথিবীর সবকিছুর উর্ধ্বে যাদেরকে নিয়ে বেশি ভেবেছি তখন তারা ছিল আমার ছেলেমেয়ে।
বাবা হয়েছি সেই কারণে বাবাকে আরও বেশি ভালোবেসেছি। আমার ছেলেমেয়ের মাকে যখন দেখি কী করে আর কী না করে জনাথান এবং জেসিকার জন্য, তখন আমি আমার মাকে নিয়ে ভাবি।
সত্যিই তো মা-বাবার সব ভালোবাসা তাদের সন্তানদের সুখের জন্য। কিন্তু আমরা এতটাই হতভাগা যে তা বুঝি না। যখন বুঝি তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।
আল্লাহ যেন আমাদের সবার মা বাবাকে সুস্থ রাখেন এবং যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আল্লাহ তাদেরকে যেন বেহেস্ত নসিব করেন। আমীন।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com