গানের মাধ্যেমে এ প্রতিবাদের কারণে তাঁকে জেল হাজতে ঢোকানো হয়।
তারপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গানের মধ্য দিয়ে নদীকে প্রশ্ন করা হয়েছে যেমন “এ কূল ভেঙে ও কূল তুমি গড়ো, যার একূল ওকূল দুকূল গেল তার লাগি কি করো?”
বর্তমান যুগের এক সৃজনশীল সাংবাদিকের প্রতিনিয়ত ধ্যানে, জ্ঞানে, শয়নে, স্বপনে এবং জাগরণে যে কথাটি আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটা হলো- নদীময় শুভেচ্ছা।
এত কিছুর পরও কৈ নদী নিয়ে কেন আন্দোলন গড়ে উঠছে না?
দেশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার মতো এককভাবে কোন প্রচেষ্টা (মন্ত্রণালয়, কমিশন, অধিদপ্তর) নেই। মন্ত্রণালয় রয়েছে, বটে তবে সমন্বয়ের ভীষণ অভাব যার ফলে নদী সুরক্ষার চেয়ে সর্বনাশ করার মতো অনেক মন্ত্রণালয় আছে। যার যত বেশি ক্ষমতা, আনুপাতিক হারে সে তত বেশি সর্বনাশ করছে নদীগুলোর। ফলে মাঝে মধ্যে কেউ নদী সুরক্ষার তাগিদ দিলেও তা বাস্তবায়নে কোনো তৎপরতা কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
দেশের ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার নদী রক্ষার দায় ভার এড়াতে পারেন না। নদীর জমি যেহেতু শ্রেণি পরিবর্তনযোগ্য নয়, তাই কখনোই ব্যক্তির নামে নদী লিখে দেওয়ার পথ নেই, তা সত্ত্বেও অনেক সময় ব্যক্তির নামে নদী লিখে দেওয়ার বড় জালিয়াতি হলেও তাঁদের নিয়ে কথা হয় না।
উপজেলা ও জেলায় ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের। এই দুই কর্মকর্তা উপজেলা ও জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি। কেউ অবৈধভাবে নদী দখল, দূষণ, পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করলে এ দুই কর্মকর্তার তা বন্ধ করার কথা। এমনকি নদী থেকে কেউ অবৈধ বালু উত্তোলন করলেও তা বন্ধ করা তাঁদের দায়িত্ব। ইউএনও ও জেলা প্রশাসকেরা কখনো অনিচ্ছায়, কখনো নেতাদের চাপে, কখনো কাজের ভারে তা যথাযথভাবে পালন করেন না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জানার কথা নদী কেন ভাঙে, শুষ্ক মৌসুমে নদী রক্ষার জন্য কী কাজ করা যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত কিন্তু তাদের সে সময় নেই।
অনেক নদী খনন করা হচ্ছে তবে খননের সময়ে কোনো নদীর প্রকৃত প্রস্থ মেপে দেখার প্রয়োজন কেউ মনে করছে না। আবার অনেক নদীকে খাল হিসেবেও খনন করা হচ্ছে কিন্তু কেন? উত্তর নেই।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন নদীর নাম-পরিচয় মুছে নদীর পাড়ে সাইনবোর্ড লিখছে খাল হিসেবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও নদীর সর্বনাশে লিপ্ত।
মৎস্য বিভাগ নদী খননের জন্য একসঙ্গে অনেক টাকা বরাদ্দ পান না তবে পুকুর খননের জন্য তাদের টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে জন্যই মনে হয় তারা নদী কেটে ছোট ছোট পুকুর তৈরি করেছে এমনটিও আমার নজরে পড়েছে। এমন কি অনেক বিলে এবং নদীতে অনেকে পুকুর কাটছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারাও একই কাজ করছে।
দেশে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় রয়েছে তিনারা আবার সব নদীতে কাজ করেন না। তাদের কাজও সামগ্রিকভাবে নদীবান্ধব নয়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কোনো নদীর ওপর দিয়ে যখন সড়ক তথা সেতু নির্মাণ করে, তখন নদীর প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক ছোট করে সেতু নির্মাণ করে। আর অবৈধ দখলদারেরা সেতুর মাপ ধরে নদীর প্রস্থ চিহ্নিত করে।
নদীর সর্বনাশকারীরা এভাবে নদীর সর্বনাশ করে চলছে অথচ কোথাও কেউ নেই সেটা দেখার! প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় এত বড় সর্বনাশ হওয়ার পরও কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু কেন? যদি কোনো সহকারী ভূমি কর্মকর্তা, সাবরেজিষ্টার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, প্রকৌশলী, মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠর শাস্তির ব্যবস্থা না করা হয় তবে দেশকে দেশের নদীকে রক্ষা করা যাবে না। আইনে ফাঁক রয়েছে, ক্ষমতায় দুর্নীতি রয়েছে যার ফলে সবাই এই অপরাধ করেই চলেছে।
যেমন একটি জলন্ত উদাহরণ দেই “জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ১২টি ধারায় শুধু সুপারিশ করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। ২০১৯ সালে যে রায়ে বাংলাদেশের নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেই রায়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনের মাধ্যমে শক্তিশালী করারও নির্দেশনা দিয়েছে আদালত। কিন্তু সেই রায় এখনো পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয় নি। নদী বিষয়ক যেকোনো কাজে কমিশনের কাছে অনুমোদন নেওয়ার কথা রায়ে বলা হলেও সরকারের কোনো সংস্থাই এ কাজ করে না।”
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী রক্ষা কমিশন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেতন তুলছে কারণ বহু বছর ধরে সেটা অনেকটা অকার্যকর। বছরে চারবার আলোচনা সভা হওয়ার কথা থাকলেও চার বছরে একবার হয় কি না, সন্দেহ। বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদীগুলোর সমস্যা সমাধানে এই কমিশনের ভূমিকা রাখার কথা কিন্তু কী হচ্ছে?
নদীর স্বার্থ রক্ষায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যখেষ্ট সচেতন হবার কথা কিন্তু কী করছেন তারা?
আমাদের দেশের সব নদীই এখন দূষিত। দূষিত নদী পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কার্যকর কী ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন? খুব জানতে ইচ্ছে করে!
বর্তমানে প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা নদী দখল করছে। স্থানীয় প্রশাসক, রাজনীতিক, ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা অনেক সময় জোটবদ্ধ হয়েও নদীর সর্বনাশ করছে। বিশেষ করে কোথাও নদী উদ্ধারে সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলে দলমত-নির্বিশেষে অবৈধ দখল বজায় রাখার স্বার্থে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লুটপাট করছে।
নদীর সর্বনাশকারীরা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের এত বড় সর্বনাশ করার পরও কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
সব মন্ত্রণালয়ের জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে যে ভাবে কাজ করার কথা, দেশ স্বাধীন হবার এত বছর পরও সেটা তেমন চোখে পড়ছে না। পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার পর দেশকে সোনার বাংলা করে গড়ে তোলার যে গুরুদায়ীত্ব অনেকই পেয়েছেন তা শুধু অবহেলা, অনাদর, অসম্মানের সাথে হারিয়ে ফেলা হচ্ছে। জীবনে এ সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে কিনা জানিনে, তবে এসেছিল জীবনে একবার!! সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন যদি থেকেই থাকে তবে নদী সুরক্ষায় এমন অবহেলা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। নদী-প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে বাংলার মানুষ ভালো থাকতে পারে না, পারবে না। চরম বিপদে পড়ে একদিন সব ধ্বংস হয়ে যাবে তেমন একটি সময়ের জন্য অপেক্ষা না করে আসুন নদী রক্ষা করতে শুরু করি। আর দেরি নয়, আর দুর্নীতি নয়, এবার দেশের কথা ভাবুন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, বুড়িগঙ্গা, নবগঙ্গা ছাড়া সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয়। সোনার বাংলা গড়ার চেষ্টা যত বিলম্বে হবে, ততই সর্বনাশ হবে নদীর। সবাইকে শেখ রোকন ভাইয়ের হৃদয় ছোঁয়া স্লোগান “নদীময় শুভেচ্ছা।”
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com