উইলসন রোগ হলো এক ধরনের বিরল প্রকৃতির জিনগত ব্যাধি, যা শরীরে তামার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে। মূলত বাবা মায়ের থেকেই সন্তানেরা এই রোগটি পেয়ে থাকে। এ রোগটি তামাকে লিভার থেকে শরীরের অন্যান্য অংশে পরিবহন করতে সহায়তা করে। এছাড়াও এটি শরীর থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে তামা শরীরের অতিরিক্ত জমা তামার দিকে পরিচালিত করে। ফলস্বরূপ জমা হওয়া তামাগুলি বিষাক্ত রূপ নেয় এবং শরীরের ক্ষতি করতে শুরু করে।
এ রোগটি বোঝা যাবে কীভাবে?
যদি বমি বমি ভাব, দুর্বলতা, পেটে অতিরিক্ত জল জমা, পা ফোলা, ফ্যাকাশে ত্বক এবং চুলকানির ভাব থাকে তাহলে চেক করা যেতে পারে।
উইলসন রোগ দেখা দিলে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় সেগুলি মূলত মস্তিষ্ক এবং লিভারের সাথে সম্পর্কিত হয়। যেমন পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া, কথা বলতে সমস্যা হওয়া, ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন হয়, যেমন উদ্বেগ, শ্রবণ ও দেখার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্ত লক্ষণ যদি নিজের মধ্যে অনুভব করেন তাহলে ডাক্তারের সাথে অবশ্যই যোগাযোগ করবেন।
উপরে বর্ণিত উইলসন রোগের লক্ষণগুলোর কোনোরকম উপস্থিতি যদি টের পান তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
পরিবারের কোনো সদস্যের যদি এই রোগ হয় কিংবা তিনি যদি সন্তান নেওয়ার কথা ভাবেন তবে জিনগত পরামর্শদাতার সাথে যোগাযোগ এবং চিকিৎসকের মতামত নেওয়া প্রয়োজন।
ইতোমধ্যেই আমরা জেনে গিয়েছি উইলসন রোগ হলো একটি জিনগত ব্যাধি। এর সঠিক চিকিৎসা নেই। তবে সময়মতো কিছু থেরাপির মাধ্যমে এর জটিলতা কমিয়ে আনা সম্ভব এবং বেড়ে যাওয়াকে আটকানো যায়। এমন কয়েকটি চিকিৎসা পদ্ধতি হলো :
ওষুধ সেবনের পাশাপাশি উইলসন রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভিটামিন ই পরিপূরক দেওয়া যেতে পারে।
যে সব খাদ্য তালিকায় তামার পরিমাণ কম সে দিকে নজর রাখতে হবে। কিছু খাবার সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো সেগুলো হলো যেকোনো দুগ্ধজাত পণ্য (যেমন দুধ, দই), প্রোটিন জাতীয় খাদ্য, দস্তা সমৃদ্ধ খাবার, যা দেহে তামার শোষণকে বাধা দিতে পারে। তবে সমস্যার তীব্রতা অনুযায়ী পুষ্টিবিশেষজ্ঞের কাছ থেকে খাদ্য তালিকা তৈরি করে নেওয়া উচিত। রোগীদের যে সমস্ত খাবারগুলি এড়িয়ে চলা উচিত, সেগুলি হলো মাশরুম, চকলেট, যেকোনো বাদাম, শুষ্ক ফল, মাংসের লিভার, শেলফিস ইত্যাদি।
লিভার ট্রান্সপ্লান্ট: উইলসন রোগের কারণে যদি লিভারের ক্ষতি মারাত্মক হয় তাহলে লিভার প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তবে সম্পূর্ণটাই লিভারের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।
যদি পরিবারের কোনো সদস্যের এই রোগ হয় তাহলে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করতে পারেন। সময়মতো চিকিৎসা করলে বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হ্রাস করা যেতে পারে। রোগটি যদি যথাযথ সময়ে ধরা পড়ে তাহলে এর জটিলতাগুলো এড়ানো যায়। যেহেতু এটি একটি বংশগত রোগ তাই এটি যদি কারো হয় সেটা সারাজীবন থাকতে পারে। তবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং যথাযথ খাদ্য অনুসরণ করলে এই রোগের জটিলতা এড়ানো যায়।
অ্যালকোহল লিভারের ক্ষতি করতে পারে। এছাড়াও অ্যালকোহল এই উইলসন রোগের প্রকোপকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই যাদের উইলসন রোগ রয়েছে তাদের অ্যালকোহল পান না করাই ভালো।
জন্ম থেকেই এই উইলসন রোগের উপস্থিতি থাকতে পারে। তবে লক্ষণগুলো ৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে প্রকট হতে শুরু করে।
আমি ডাক্তার নই তবে ঘটনাটি লিখতে উপরের তথ্যগুলো জানতে হয়েছে।
আজ বাড়িতে এসেছে আমার ছেলে-মেয়ের কলেজের অধ্যক্ষ জর্গেন জেনসন এবং তাঁর স্ত্রী গুনিলা।
জর্গেনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি কিছুটা ভিন্ন এই কারণে যে তিনি টেনিসের পাগল। আমার ছেলে-মেয়ের টেনিসের সাথে তিনি প্রথম থেকেই জড়িত ব্যক্তিগতভাবে, যার ফলে মাঝে মধ্যে পারিবারিকভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয়।
জর্গেনের ছেলের উইলসন রোগ ধরা পড়ে গত এক বছর আগে। হঠাৎ তার প্রচন্ড বমি শুরু হয় এবং তৎক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালর ইমারজেন্সিতে নেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নানা ধরনের চেক আপ করার পর সিদ্ধান্তে আসেন তাকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করতে হবে। পুরো স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সকল হাসপাতালে অ্যালার্ম দেয় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে না পারলে রোগীকে বাঁচানো যাবে না। ৭ ঘণ্টার মধ্যে প্রথম যে লিভারের সন্ধান পাওয়া যায় সেটা এসেছে অ্যাম্বুলেন্স হেলিক্যাপ্টারে করে ফিনল্যান্ড থেকে। যিনি রোগীকে অপারেশন করবেন তিনি লিভার চেক করার পর জানতে পারেন যে এ রোগীর জন্য এ লিভার সুইট্যাবেল না। নতুন করে অ্যালার্ম দেওয়া হয় এবং ২৩ ঘণ্টা পর পরবর্তী লিভারের সন্ধান মেলে ডেনমার্কে, সেটাও টেস্ট করে জানা গেছে এ রোগীর জন্য এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। কী আর করা! নতুন করে অ্যালার্ম দেওয়া হলো, সময় তার গতিতে চলছে জর্গেনের ছেলের জীবন বিনাশের দিকে।
এদিকে ৪৫ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, কী করা! হঠাৎ নতুন খবর পাওয়া গেল সুইডেনের একটি রোড এক্সিডেন্টে একটি অল্প বয়স্ক ছেলে মৃত্যু বরণ করেছে, তার লিভার চেক করে দেখা গেছে জর্গেনের ছেলের জন্য সঠিক। প্রসঙ্গত, পাশ্চাত্যে অনেকেই জীবিত অবস্থায় তাদের শরীরের অর্গান ডোনেট করে থাকে এবং মৃত্যুর পরও যদি কোনো অর্গান কাজে লাগে তাতে তাদের সম্মতি থাকে তবে নির্ভর করে কীভাবে মৃত্যুবরণ করে তার উপর। চিকিৎসক বিশেষাঙ্গ ৭০ ঘণ্টার মাথায় রোগীর অপারেশন করেন এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে সেটা সম্পন্ন করেন।
আজ ডিনারে পুরো ঘটনাটি যখন জর্গেন বর্ণনা করলেন তখন আমি যেমন মনোযোগী ছিলাম তেমন ইম্প্রেজড হয়েছি সুইডেনের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা জানতে পেরে। অনেক ছোটখাটো চিকিৎসায় ব্যর্থতা থাকলেও জটিল বা ক্রিটিক্যাল সময়ে সত্যি এদের চিকিৎসার পারদর্শিতা প্রশংসা করার মতো। বিষয়টি শেয়ার করলাম শুধু অনুপ্রেরণা যোগাতে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং চিকিৎসকদের জন্য, আমার শেয়ার ভ্যালুর কনসেপ্ট থেকে।
জর্গেন এবং গুনিলা যখন ঘটনাটির বর্ণনা দিচ্ছিল আমার অনুভূতিতে বার বার বাংলাদেশের চিকিৎসার কথা মনে পড়ছিল এই ভেবে, কবে হবে এমনটি বাংলাদেশে। আরো মজার ব্যাপার সেটা হলো এতবড় একটি জটিল এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসা যা সম্পন্ন করতে কম পক্ষে ৫০- ৬০ লক্ষ টাকা দরকার হয় অথচ জর্গেন এবং গুনিলার খরচ হয়েছে মাত্র ২ হাজার সুইডিশ ক্রোনার (২০ হাজার টাকা মাত্র)।
গণতন্ত্রের দেশে ট্যাক্স পে করা জাতি তার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে কোনো রকম জড়তা ছাড়া তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভাবছি কবে এমনটি গণতন্ত্র হবে বাংলাদেশে! হবে নিশ্চয় হবে, তবে সময় লাগবে কারণ যখনই সত্যের সাথে মিথ্যার লড়াই হয় তখন সত্য একা হয়ে লড়াই করে। অন্যদিকে অসত্যের দল হয় বিশাল বড়, কারণ অসত্যের পিছনে মূর্খ, লোভি, স্বার্থপর ও বিশ্বাসঘাতকেরা থাকে, যার ফলে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সত্যের জন্য লড়াই করতে থাকলে একদিন সত্যের জয় হবেই।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com