তারপর যদি কেউ বিদেশি হন তখন ভাষা, বর্ণ, ধর্ম সব মিলে ভেবেছেন কি কত বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হবে? প্রতিযোগিতার যুগে সারাক্ষণ হার মেনে নিলে শেষে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসতে হবে। তারপর যদি সেই ফেরার দেশে আপনি সংখ্যালঘু হন তাহলে তো সমস্যার শেষ নেই। পুরো জীবনটাই হচ্ছে সেকেন্ড প্লেস ইজ ফর লুজার। সে ক্ষেত্রে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বলে কোনো কথা নেই, সেকেন্ড প্লেস ইজ ফর লুজার। এখন যদি লুজার হয়ে বেঁচে থাকতে না চান তাহলে পেছনে পড়ে থাকা চলবে না, যাকে সুইডিশ ভাষায় বলা হয় “Kom inte sist”. এখন পিছনে যাতে না পড়া লাগে তার জন্য কী করণীয়, আসুন সে বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করি।
বিশ্বের সংখ্যালঘুদের মধ্যে বাংলাদেশের হিন্দুরা অতি সহজেই নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতে আশ্রিত হয়। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে! হয়তো বলবেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যখন কোনো উপায় না থাকে তখন ধাক্কা না দিয়ে সহজে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এখন ভাবুন ভারত যদি প্রতিবেশী দেশ না হতো তাহলে কী করতেন? কিংবা ভাবুন ভারত যদি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হতো তাহলে কী করতেন? অথবা ভারত যদি বাংলাদেশের চেয়েও দুর্বল হতো তাহলে?
আমি নিশ্চিত তখন চেষ্টা করতেন বাংলাদেশেই টিকে থাকতে। এখন যেভাবে ভারতের মুসলমানরা ভারতে টিকে আছে ঠিক সেভাবে আপনারাও বাংলাদেশে টিকে থাকতেন। দেখুন পাশের দেশ চীন সেখানেও মুসলমান সংখ্যালঘুদের বাস, কই তারা তো সব ছেড়ে চলে যাচ্ছে না?
প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়কালে বাংলার মুসলমানদের ওপর ব্রিটিশ এবং হিন্দুদের অত্যাচার চলে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। পরে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ যেখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বীর অধিকার সমান বলে স্বীকৃতি পায়। পরে ধাপে ধাপে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম আঘাতটি আসে ১৯৭৭ সালে যেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। শেষে ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। দুটি ঘটনা সামরিক সরকারের আমলে হলেও গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রীয় আদর্শকে অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
পাকিস্তান আমল থেকেই দফায় দফায় বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ঘটনায় পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। হিন্দুদের দেশ ত্যাগের কারণটি মুসলমানদের মনে যে চেতনা দিয়েছে সেটা হলো মুসলমানরা ধরে নিয়েছে বাংলাদেশটা এখন তাদের। বাংলাদেশে কিছু হলেই হিন্দুরা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। এই দেশান্তর জনসংখ্যার অনুপাতে প্রভাব ফেলে।
ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার রাজধানী হিসেবে কলকাতার প্রতিষ্ঠা, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের মতো বড় বড় ঘটনা পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের হিন্দুদের একটি অংশকে ভারতমুখী করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেন। শরণার্থীদের বড় একটি অংশ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। তারা দেশ ছেড়েছে শরণার্থী হিসেবে এবং পরে দেশে ফিরে আসেননি, ফিরে এলেও কেউ কেউ আবার ভারতে চলে যান।
বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে যেখানে ভূমিপুত্রদের দেশহীন ও সহায়-সম্বলহীন করে দেশান্তর করার জন্য যত রকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা যায়, সেটা করে সংখ্যালঘুদের শেষ করা হয়েছে এখনো হচ্ছে।
লক্ষ করুন বর্তমানে এশিয়ার পরাশক্তি চীনে সংখ্যালঘু মুসলিম, দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ দেশ ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থা। বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় সেটা হলো সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করার পেছনে অনেকেই ঐক্যবদ্ধ। সুশীল সমাজ এক্ষেত্রে চুপ। সংখ্যালঘুদের কেউই বিশ্বের কোথাও বলতে পারবে না যে তারা তাদের জন্মভূমিতে নিরাপদে বসবাস করছে।
বাংলাদেশে শুধু সংখ্যালঘু নয় যারা রাষ্ট্রের সমালোচনা করে তারাও নিরাপদে বসবাস করছে না। শারীরিক নিরাপত্তা থেকে শুরু করে মানসিক নিরাপত্তার অভাব তাদেরকে নিত্যদিনে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এরপরও বিশ্বে নানা সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে চলেছে। যে দেশে সকল জাতি সম্প্রদায়, ভাষা, বর্ণ, ধর্ম একত্রে বাস করতে না পারে সে দেশকে সৃজনশীল রাষ্ট্র বলা যেতে পারে না।
যেমন- একটি ফুলের বাগানে শত শত নানা ধরণের ফুল থাকা সত্ত্বেও যদি বলি গোলাপ ফুলের বাগান, তাহলে কি ঠিক হবে? তেমনি সকল জাতি সম্প্রদায় একটি রাষ্ট্রে বাস অথচ যদি বলি ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ তখন কী হয়? তখন রাষ্ট্রের সকল তন্ত্রমন্ত্র এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। যার ফলে হয় সমস্যা সংখ্যালঘুদের জীবনে।
আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আশঙ্কা করছি বাংলাদেশে একদিন একটি হিন্দুও অবশিষ্ট থাকবে না যদি তারা তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য ফাইট না করে। এই ফাইট করার মনোবল না থাকার কারণে এবং অতি সহজে দেশ ত্যাগ করার সুযোগ থাকায় তারা দিনের পর দিন সংখ্যালঘু হচ্ছে। অথচ এ সমস্যা অনেক মুসলমানদেরও রয়েছে কিন্তু তারা দেশ ছেড়ে কোথাও যাচ্ছে না কারণ সুযোগ নেই।
আমি যখন বাংলাদেশে বসবাস করেছি তখন দেখেছি হিন্দু সম্প্রদায় রাতের আঁধারে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে। তাদের পরিবারের প্রায় অর্ধেকের বসবাস সেই পাড়ে। বাকিরা আস্তে আস্তে সব কিছু বিক্রি করে রাতের আঁধারে দেশ ছেড়েছে। এ ধরণের ঘটনা প্রায় প্রতিবছরই ঘটে। সব সময় যে সাম্প্রদায়িক হামলার কারণে তা নয়, তারপরও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এগুলো ঝোঁকের মাথায় নিছক ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। এর পেছনে থাকে মূলত ভূমি দখলের রাজনীতি।
হামলাকারীরা সাধারণ কোনো মানুষ না, ধর্মীয় অনুভূতির সুড়সুড়ি দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে এদের মূল লক্ষ্য হাসিল করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে রাষ্ট্র নিশ্চুপ থাকায় হামলাকারীরা প্রশ্রয় পায়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্রমাগত চাপ প্রয়োগে উৎসাহিত করে, যে পর্যন্ত না তারা ভূমি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক সময় সেই হামলাকারীদের কাছেই নামমাত্র মূল্যে জমিটি বেঁচে দেয় তারা।
ক্ষমতার ক্রমাগত চাপে এবং তাপে ততদিনে তারা জেনে যায়, বাপ-দাদার ভিটা-বাড়িতে তারা আর থাকতে পারবে না। সাম্প্রদায়িক হামলার ধারাবাহিকতার পরও মৌখিক হুঁশিয়ারি ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি সরকার থেকে?
বাংলাদেশের প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে যখন-তখন ধর্মকে ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে তারাও নিশ্চুপ থেকে এই হামলাকারীদের রাজনৈতিক আশকারা দেয়। বলা হয় ধর্ম যার যার, উৎসব সবার, রাষ্ট্র সবার, এ ধরনের কথাবার্তা যে শুধুই মুখের বুলি, তা প্রায় প্রতিবছরই ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো দেখলেই বুঝা যায়। এর জন্য দায়ী লোকগুলো কারা জানেন? আমরা সবাই। কারণ এতগুলো বছরে এদেশ থেকে নীরবে নিভৃতে হিন্দুদের দেশত্যাগের বিষয়ে আমরা কেউ কিছু করতে পারিনি।
হিন্দুদেরকে মুসলমানদের মতোই সমান নাগরিক সুবিধা নিয়ে বেঁচে থাকতে দেখেছি অতীতে। কিন্তু সেটা এখন আগের মতো কারো ক্ষেত্রে নেই। কারণ দেশে যখনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে, ফেসবুক থেকে শুরু করে মিডিয়া পর্যন্ত একদল তত্ত্বমারানি আবির্ভূত হয়। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চায়- দোষ আসলে অন্য কারো, হামলাকারীরা নির্দোষ। এর পেছনে কারণ একটাই তা হলো এরা আসলে হামলাকেই জাস্টিফাই করে। কিন্তু কেন সরকার থেকে শুরু করে সবাই সরল-সিধা ভাষায় নিন্দা জানিয়ে হামলার প্রতিবাদ করি না?
আক্রান্ত-অনাক্রান্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াতে পারি না? অপরাধীদের নাম মুখে আনি না? বলি না সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিকে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতা গ্রাস করছে। একটি হামলার ঘটনায় জড়িতদের উপযুক্ত বিচার হয় না বলেই আরেকটি ঘটে। এসবের প্রতিবাদ না করতে পারলে ভারতের মুসলমানদের মত চুপ থাকুন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আক্রান্ত ঘায়ে নুন ছিটাবেন না। ‘simply just keep your mouth shut down.’
এখন হইছে অনেকটা- যে নেই তার জন্য সবকিছু আর যে আছে তার জন্য নেই কিছু। যে দেছে তাকে নয় বরং যে নেছে তাকে মনে রাখো। দ্বিমত পোষণ করলে সব যাবে সহমত পোষণে সব পাবে। অ্যাগ্রি ট্যু ডিজঅ্যাগ্রি বলে কিছু নেই। সে আবার কী? এখানে সবাই অ্যাগ্রী। এ কোন দেশ? এর নাম এখন বাংলাদেশ।
আমি চিৎকার করে ঘৃণা করতে চেয়েও পারছি না চিৎকার করতে। মনের দুঃখে লিখতে বসেছি একই সাথে নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছি। বাংলাদেশ কারও একার নয়। এটা হিন্দু-মুসলিম সবার। সবাই এখানে মিলেমিশে থাকবেন। দেশের বাসিন্দারা নিশ্চিতে এখানে বসবাস করবেন। আমরা যদি ধর্মীয়, বিএনপি, জামাত বা আওয়ামী লীগ সংকীর্ণতায় ভুগি, তাহলে এভাবেই চলতে থাকবে। এখানে যুগ যুগ ধরে সব বর্ণ, রাজনীতি এবং ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বাস করে আসছি। আমরা যেভাবে এখানে ছোটবেলা থেকে মিলেমিশে বাস করছি, ভবিষ্যতেও করব।
যাদের ভেতরে সংকীর্ণতা আছে, সেগুলো বাদ দিতে হবে। উদার হতে হবে। নিজেকে এলাকার সন্তান হিসেবে, এ মাটির সন্তান হিসেবে আমার দায় আছে। আমি সব সময় খোঁজ রাখব। এলাকার পরিস্থিতি সব সময় আমার নজরে থাকবে। আপন জন্মভূমির ওপর বিশ্বাস ভঙ্গ করা মহাপাপ এই বিশ্বাস ও আস্থা ধরে রাখা ছাড়া নিজেদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক বলে দাবি করার সুযোগ নেই। যারা সমস্যা সৃষ্টি করে তারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য দায়ী।
এদের পরিষ্কার ভাষায় বলে দিতে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের বা সংখ্যালঘুদের উপর কোনো অন্যায় আমাদের বাংলাদেশ মেনে নিবে না। মধুরাত নয়, মায়া চাঁদ নয়, আসুন মানুষের কথা ভাবি।
লেখক: সাবেক পরিচালক
প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট
ফাইজার, সুইডেন থেকে