কিন্তু বহিঃশত্রুকে তাড়িয়ে আমার সন্তানরা আমাকে মুক্ত করেছে। আমার অনেক সন্তান আমার জন্য জীবনও দিয়েছে। তারা আমার বুকে আশ্রিত আমার ভালোবাসায়। আমাকে তারা ভালোবাসা দিয়ে মুগ্ধ করেছে। ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা আমার সন্তানদের নিয়ে সুখে কাটাব। কারণ আমার তো সবই আছে। আমাকে আমার সন্তানেরা স্বাধীন করেছে, তাই তাদের জন্য আমি সব উজাড় করে দিয়েছি। আমার ভূমিতে তারা যা রোপন করছে তাতেই ফলছে প্রচুর ফসল এবং আমিই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে যে যা ইচ্ছে তাই ফলাতে পারে।
সবাই বলে আমি নাকি সোনার বাংলা। আমাকে সকল দেশের রাণী বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমি অনেক আশা ভরসা নিয়ে শুরু করেছিলাম এক উন্নত সমাজ গঠনের এই যাত্রা। আমি সব সময়ই চাই আমি আমার সব সন্তানদের নিয়ে সারা বিশ্বের বুকে গর্বের সঙ্গে বসবাস করব। কিন্তু কী চেয়েছিলাম আর কী হতে চলেছে।
আজ ৫০ বছর কেটে গেলো! কিন্তু কোথায় সেই উন্নত সমাজ? আমি তো আর পারছি না এই পশ্চাদপদতা সহ্য করতে! কী অন্যায় আমি করেছি যে আমার নিজের সন্তানরা আজ আমার বুকে ঢালছে বিষাক্ত বিষ এবং আমার উর্বরতাকে করছে ধ্বংস। আমার কর্মক্ষমতাও নষ্ট করতে চেষ্টা করছে! আমার ভূমিতে বাস করা নানান জাতিসত্তার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের বিতাড়িত করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
অথচ তারাও আমার সন্তান। তারা নিজেদের মধ্যে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে একে অপরকে শেষ করছে। তারা আমার নামের ওপর কলঙ্কের ছাপ ফেলছে। এইগুলো নিয়ে আমাকে গোটা বিশ্বের সবাই ঠাট্টা করছে! আমাকে সবাই কলঙ্কিনী বলছে! আমাকে অনেকে বলছে আমার সন্তানেরা অনেকেই দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর। কিন্তু কেন? কী অন্যায় আমি করেছি যে আমার সন্তানরা আমাকে সারা বিশ্বের কাছে এত ছোট করছে? ছোটই যদি করবে তবে কেন তারা আমাকে বহিঃশত্রু তাড়িয়ে স্বাধীন করেছিল? আমিতো আর সহ্য করতে পারছি না!
তারা দিনের পর দিন অন্ধকার আর অধঃপতনের দিকেই কি চলবে? তারা শিক্ষা বিসর্জন দিতে চলেছে। তারা কু-শিক্ষার বীজ বপণ করতে শুরু করছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক বড় বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে।কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট, উত্তম পাঠ্যপুস্তকের অভাব এবং অতি অবশ্যই ভালো শিক্ষকের অভাব খুব লক্ষনীয়। কিন্তু তারা এখনও ভাল শিক্ষক তৈরির কোনো ভিত গড়ে তুলতে পারেনি এবং এটা নিয়ে কেউ ভাবতেও চায় না।
চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম না চালিয়ে শুধু লাখ লাখ সার্টিফিকেটধারী গ্র্যাজুয়েট বের করে তারা আমার সংকট আরও ঘনীভূত করছে যেটা কেউ মানতে নারাজ। চাহিদাভিত্তিক, জ্ঞান নির্ভর, পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন যে সত্যিকারের মানব সম্পদ তৈরির সেরা উপায় সেটাও তারা স্বীকার করছে না। তাই সারা দেশে স্কুল কলেজে ছেয়ে গেলেও মানসম্পন্ন সুশিক্ষা ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে না।
যাদের শিক্ষার কারিগর বলে আমি গর্ব করতাম তারাও এখন উঠে পড়ে লেগেছে আমার মুখে চুনকালি মাখাতে। তারা শুধু দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলাই নয়, সক্রিয়ভাবে পরীক্ষায় নকল করাকে সাহায্য করছে যাতে করে প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে না হয় পরীক্ষার খারাপ ফলাফলের কারণে। তারা আমাকে পৃথিবীর নিম্ন মানের সারিতে ফেলতে চেষ্টা করছে।
আমার ১৭ কোটি সন্তানের মধ্যে কেউ কি নেই যে এর প্রতিবাদ করতে পারে? আমার এই দুর্দিনে কি কেউ নেই যে সত্যি আমাকে সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে? মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারে? কেন এত নিশ্চুপ তারা? কেন? আমার ভালোবাসা তো তাদের জন্য কখনও কমেনি! আমার যা আছে তা যদি তারা মিলেমিশে দেখাশোনা করে রাখে তাদের তো কষ্টে থাকার কথা নয়।
আমাকে তারা সোনার বাংলা করার স্বপ্ন দেখিয়েছে। তারা প্রতিদিন শপথ গ্রহণ করে আমাকে ভালোবাসে বলে অথচ তার পরেও কীভাবে তারা পারে আমাকে এ ভাবে কষ্ট দিতে? আমার গর্ব, আমার বিশ্বাস, আমার আশা, আমার ভরসা তারা কি ফিরিয়ে আনতে পারবে না আমার বুকে! আমাকে তারা কি সুশিক্ষিত় জাতি গড়ে দিতে সক্ষম হবে না! আমি তো কলঙ্কিনী মা হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না! আমি ভালোবাসার সোনার বাংলা হয়ে তাদের মাঝে থাকতে চাই।
আমাকে তারা সোনার বাংলা করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমি চাই তা তারা প্রতিটি পদক্ষেপে পালন করুক। তারা ধর্ম, গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি, বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করুক এবং ভন্ডামী ও অনৈতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশ ও জাতির খেদমত করতে চেষ্টা করুক। সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের মাঝে আমাকে মর্যাদাশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলুক। আমার প্রত্যেকটি সন্তান গর্বের সঙ্গে মনে-প্রাণে ও ধ্যানে বলুক ‘সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্ম ভুমি’ এমন প্রত্যাশা নিয়ে আমি রইলাম আগামীর পানে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com