তন্ত্র একটি অন্তর্নিহিত অর্থ। তন্ত্রে যেসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতি-নীতির বর্ণনা রয়েছে তার উদ্দেশ্যই হলো মানুষকে অজ্ঞানতা ও পুনর্জন্মের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া।
খ্রিস্ট্রীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে তন্ত্র সাধনার বিকাশ লাভ করলেও মূলত বৌদ্ধধর্মের হাত ধরেই পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে এই তন্ত্রশাস্ত্রটি। তন্ত্র এমনই একটি শাস্ত্র যার মাধ্যমে নিজেকে অনুসন্ধান করা যায়। নিজের অন্তরের খবর পাওয়া যায়।
তন্ত্র শব্দটির অর্থ ব্যাপক, সংক্ষেপে তন্ত্র হচ্ছে "সৃষ্টির পরিচালনার নিয়ম”। তন্ত্রের বিষয়টা অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। সাধারণভাবে, তন্ত্র অসীম জ্ঞানের আধার। তন্ত্র জ্ঞানচক্ষু উন্মোচন করে, সৃষ্টির কারণ বুঝতে সাহায্য করে তন্ত্র। তন্ত্র সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশের পরিচালনার শক্তি।
তন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত আছে মন্ত্র, যন্ত্র। তন্ত্র সাধনায় সাধক সৃষ্টির রহস্য জেনে পরমানন্দ অনুভব করে।তন্ত্রের প্রধান একটি সিদ্ধান্তই হলো এই যে প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করা। কিন্তু, শক্তি কী? বিশ্বজগতে সবই তো শক্তির সমাহার। যে শক্তিকে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। আধুনিক সভ্যতা এই মূলতত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সূত্র আবিষ্কার করে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যৌক্তিক এই প্রশ্নও তো আজকাল উঠছে।
প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তন্ত্রের সিদ্ধান্ত কী?তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে। এই হলো বিজ্ঞান এবং তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে।
তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হলো তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, প্র্যাকটিস। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।
তন্ত্র একটি জটিল বিষয়। ভারতবর্ষের আর্যকেন্দ্রিক আধ্যাত্ম ঐতিহ্যে এর স্থানটি নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী ধ্যানধারণা রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, তন্ত্র সম্বন্ধে 'সংক্ষেপে' কিছু লিখে ফেলা আমার মতো অনধিকারীর পক্ষে অসম্ভব। বিপুল এর ইতিহাস, বিশাল এর বিস্তৃতি।
এখন এই রাজা, প্রজা, সমাজ, একনায়ক, গণ এসবের শেষে তন্ত্র যোগ করে সৃষ্টি করা হয়েছে রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্র প্রভৃতি। বহু যুগ, বছর ধরে চলে আসছে এর ওপর শাসনতন্ত্র। এখন এই শাসনতন্ত্রে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে জনগণকে। জনগণ কখনও কালেক্টিভ কখনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যেমন: একটি উদাহরণ করোনা মহামারিতে জনগণ কালেক্টিভ ভূমিকা পালন করছে কারণ এখানে জীবন-মরণ প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু ধনী দরিদ্রের ক্ষেত্রে জনগণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আবার রাজনীতির উদ্দেশ্য সফলে জনগণ কালেক্টিভ। একজন ধনি ব্যক্তি দিব্যি জঙ্গল থেকে কুকুর, বিড়াল ধরে এনে বাড়িতে বদ্ধ ঘরে বন্দি করে রেখে সমাজের কাছে পশুভাজন সাজে।
অন্যদিকে প্রতিদিন শত শত পশুপাখির জীবন নাশ হচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। যদি সত্যিকারার্থে সমাজের এসব ধনী ব্যক্তিগণ পশুপাখির ভক্ত হন তাহলে কেন যৌথভাবে সকল পশুপাখির জন্য কিছু করেন না? কারণ আমরা মানুষ জাতি শুধু সুবিধাবাদি হতে শিখেছি, কখনও তন্ত্রের বেস্ট প্রাক্টিস করতে শিখিনি। আমরা এখনও সেই তন্ত্র-মন্ত্রের দোহাই দিয়ে শাসন করে চলছি একে অপরকে। আমরা ক্ষেত্রবিশেষে আমিতন্ত্র এবং ক্ষেত্রবিশেষে আমরাতন্ত্র। উপরের বর্ণনায় যতটুকু ধারণা হলো তাতে মনে হয় আমাদের আমি থেকে আমরা না হয়ে হতে হবে আমি এবং আমরা। কারণ আমি থেকে আমরা হবার প্রবণতা আমাদের সব সময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক করতেই সাহায্য করে। যেহেতু তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হলো তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, দরকার প্র্যাকটিস। এখন সেই প্র্যাকটিস হবে বিশ্বে তথা দেশে গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাকটিস।
এখন বৃটিশ, ভারত বা বাংলাদেশের সংবিধানের মূলমন্ত্রে গণতন্ত্রের যে পরিকাঠামো রয়েছে তাতে পরিষ্কার যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাক্টিসে দুর্নীতি বেশি জড়িত। এই দুর্নীতির কারনে যেভাবে দেশ চলার কথা সেটা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন: প্রধানমন্ত্রী একাই যদি নিয়োজিত ‘সংসদ’ এবং নির্বাহীসহ অন্য সব নাগরিকের মধ্যে আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য ‘বিচার বিভাগ’ ও জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনে ‘নির্বাচন কমিশন’ গঠন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন, কি হবে? সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা সম্ভব হবে না। এ পদ্ধতিকে সংজ্ঞা অনুসারে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।
বর্তমানে আমাদের সংবিধানের মূলনীতির অন্যতম ‘গণতন্ত্র’, প্রস্তাবনায় এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তা ছাড়া আমাদের দেশের নামকরণ করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। স্বাধীনতা সংগ্রামসহ গণমানুষের সব আন্দোলন-সংগ্রামের মূল প্রেরণা ছিল গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি। সে দেশের বর্তমান সংবিধানের অনেক বিধান এ ধ্যানধারণার পরিপন্থী। ফলে অনতিবিলম্বে বর্তমান সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন ও সহায়ক আইন প্রণয়ন অত্যাবশ্যক, কারণ গণতন্ত্র অর্থ জনগণের শাসন।
জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত করতে হবে এবং সেটাই গণতন্ত্রের চর্চা। যেহেতু দেশের সব মানুষ একসঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে পারছে না, তাই শতভাগ গণতন্ত্র কোনোভাবেই বলা যাবে না বা সম্ভবও নয়। তাছাড়া সবার প্রত্যাশা এক না, ফলে তা বাস্তবায়নও অসম্ভব। তবে যত বেশিসংখ্যক মানুষ অনুভব করবে তাঁদের প্রতিনিধিরা তাঁদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার প্রতিফলন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে দেখাতে পারছে, ততটুকু গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে বলা যেতে পারে। দেশের মানুষের যদি এ ধরনের উপলব্ধি হয় যে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী জনপ্রতিনিধি শাসন করছেন, তাহলেই দেশে গ্রহণযোগ্যভাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু আছে বলা যেতে পারে। এর জন্য অবশ্যই জনগণের কাছে সরকারের সার্বক্ষণিক জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন।
স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তীর পরও বলা যায়, সার্বিক বিবেচনায় স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে কোনো সময় গণতন্ত্রের চর্চা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে ছিল না। এর প্রধান কারণ, আমাদের সংবিধান। সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে এবং বিভিন্নভাবে গণতন্ত্রের চর্চার বিষয়ে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে সংবিধানের বিভিন্ন বিধানে গণতন্ত্রের চর্চার চেয়ে একনায়কতন্ত্রকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে অনেক ধরনের পরিবর্তন আনা হলেও গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ সৃষ্টির জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতায় আসীন হয়ে সরকার গণতন্ত্রের চর্চার সুযোগ সংকুচিত করেছে। গণতন্ত্রচর্চার সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে প্রায় ধ্বংস করা হয়েছে/ হচ্ছে। কবে এসবের অবসান ঘটবে? আমি সেদিনের অপেক্ষায়।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com