বিশ্বায়নের মাধ্যমে বিশ্ববাসী তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে নিজেদের নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছে। এতে করে জাতি বা রাষ্ট্রের ধারণাটি উঠে গিয়ে সমগ্র বিশ্ব একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। যার ফলে এখন মনে হচ্ছে করোনা এবং বিশ্বয়ন সামগ্রীক কমিউনিটির মধ্যে সমস্ত মানুষকে নিয়ে আসার একটি প্রক্রিয়া। সুতরাং আশা করা যেতে পারে যে বিশ্বায়ন এবং করোনা হচ্ছে গোটা বিশ্বের সকল সমস্যার সীমারেখাহীন বিশ্বব্যবস্থা, যার দ্বারা বিশ্বে কোন এক সময় আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক তৈরি হবে।
তবে শুরুতে কথা ছিল বিশ্বায়ন হবে বিশ্ব অথনৈতিক ব্যবস্থা। বাণিজ্যকে বাধাহীনভাবে বিশ্বব্যাপী পরিচালনা করার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা হবে বিশ্বায়ন। সারা বিশ্বে পণ্য ও পুজির অবাধ প্রবাহ থাকবে। কিন্তু কী হলো? সারা বিশ্বকে এক কেন্দ্র থেকে শাসন করার নতুন অথনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কৌশল তৈরি হলো, দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রনের জন্য ধনী রাষ্ট্রগুলোর অথনৈতিক প্রভাব পড়ল। বিশ্বায়ণ হলো উপনিবেশের এক নব্য রূপ।
বিশ্বায়নের ফলে পুজিবাদীরা তাদের পুজি বৃদ্ধি করার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্বায়ন দিয়ে তারা নব্য উপনিবেশ তৈরি করতে পেরেছে। বিশ্বায়নের নাম দিয়ে পুজিবাদীরা বিশ্ব রাজনীতি, অথনীতি ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রন করার বৈধতা পেয়েছে। সামরিক শক্তিকে ব্যবহার না করে বিশ্বায়নকে ব্যবহার করে এখন সারা বিশ্বকে এককেন্দ্র থেকে শাসন করা হচ্ছে।
বতমানের বিশ্বায়নের বিকাশে সবচেয়ে বেশি অবদান বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির। প্রয়োজনের ভিক্তিতে গড়ে ওঠে একের পর এক তাবেদারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন যা বিশ্বায়নকে বিকাশিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। তবে বিশ্বায়নকে প্রথম দিকে এমনভাবে প্রচার করা হয় যেমন বিশ্বায়ন প্রতিষ্ঠা হলে গরীব দেশগুলোই বেশি লাভবান হবে। কিছুটা যে হয়নি তা নয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাভবান হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো আর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে গরীব দেশগুলো।
বিশ্বায়নের নাম দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ চলছে। শান্তি রক্ষার নামে বিভিন্ন দেশে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে বিভিন্ন দেশের সাবভৌমত্ব ধ্বংস করা হচ্ছে। নিরাপত্তার নামে লুটপাঠ চলছে। শান্তি আলোচনার নামে দ্বন্দ্বকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে। শত্রু দ্বারা শত্রু ধ্বংস করা হচ্ছে আর এসব অপকর্মের বৈধতার জন্য বিশ্বায়নকে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন জঙ্গিদের হাতে অস্ত্র দিয়ে বিশ্বায়নের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনে জঙ্গিদের সুবিধা দিচ্ছে। জঙ্গিদের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে অন্য দেশে হস্তক্ষেপের বৈধ উপায় তৈরি হচ্ছে। আর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এ থেকে নিজেদের মত সুবিধা নিচ্ছে।
বিশ্বায়নের ধারণাটা পুজিবাদী ও ধনী শাসকশ্রেণীর তাই তারা যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-২০, নিরাপত্তা পরিষদ, ন্যাটো প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তৈরি করে ধনী রাষ্ট্রগুলো তাদের সুবিধার জন্য বিশ্বায়নকে ব্যবহার করছে। এসব দেশের মধ্যে বানিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পক খুবই ভাল, এসব দেশের মধ্যে ভিসা ছাড়াই তারা চলাচল করতে পারে। এক অপরের বিপদে এগিয়ে আসে। এসব রাষ্ট্রগুলো একসাথে কাজ করে। আর সকল অসুবিধা ভোগ করতে হয় গরীর ও অনুন্নত দেশগুলোকে।
শ্রমিকের যোগান দিতে, অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাঙ্গতে, ধর্মকে ধ্বংস ও বিভক্তি করতে মৌলবাদী সশস্ত্র জঙ্গিদের তৈরি করছে, কিন্তু এর ভুক্তোভুগি তারা হচ্ছ না, হচ্ছে গরীব উন্নয়নশীল দেশগুলো। আবার সমস্যা সমাধানের নাম দিয়ে এসব দেশে সরকার ও জঙ্গিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব টিকিয়ে রাখছে আর তারা তৃতীয় পক্ষ হয়ে দুই পক্ষ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। সরকারকে বলছে জঙ্গিদের ধ্বংস করতে আবার জঙ্গিদের বলছে সরকারকে ধ্বংস করতে। সাম্রাজ্যবাদী এসব দেশ দুই পক্ষকেই ধ্বংস করে রাষ্ট্রকে বেসরকারি খাতে নিয়ে যেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জঙ্গিদের লুটপাটের অবৈধ অর্থের স্বীকৃতি দিয়ে সভ্য রাষ্ট্রের নামধারী এসব রাষ্ট্রগুলো প্রমান করে তারা বিশ্বায়নের নামে সন্ত্রাসীদের লালন করছে। ইন্টারনেট নেটওয়াকও তাদের হাতে কিন্তু দেখা যাচ্ছে জঙ্গিরা এর অপব্যবহার করছে তখন কিছু বলছে না শুধু স্বাথে আঘাত পড়লেই তারা দমন করছে। বিশ্বব্যাপী সামরিক খাতে ব্যয়ের মাত্র এক শতাংশ অর্থ দিয়ে পৃথিবীর প্রত্যেক শিশুকে সাধা- কালো বোর্ডের সামনে দাঁড় করানো সম্ভব। বিশ্বায়নের ফলে বেড়েছে বৈসম্য, ক্ষুধা, দারিদ্রতা। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ, বাড়ছে বিভেদ হানাহানি সমাজে।
বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বে বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটেছে, চিকিৎসাক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটেছে, মানুষ আদিম যুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে, উন্নতমানের জীবনের স্বপ্ন দেখতে পেরেছে, উন্নত যোগাযোগ মাধ্যমের যোগাযোগ করতে পারছে। বিশ্বায়নের ফলে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমন করতে পারছে। মানুষ তার নিজের এবং তার দেশের পাথক্যটা বুঝতে পারছে। বিশ্বায়নের ফলে মানুষের মাঝে উন্নতির ছোয়া এসেছে। পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বায়ন এমন একটা বিষয় যা দ্বারা অনেক সমস্যা যেমন তৈরি করা হয়েছে তেমন বিশ্বে যে সমস্যা আছে তার সমাধানও করা হচ্ছে।
যে ধারণা নিয়ে বিশ্বায়নকে প্রদান করা হয়েছিল সে ধারণা যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে সবাই এর সুফল পাবে। বিশ্বায়ন সমস্যা তৈরিতে সহায়ক না হয়ে যদি সমাধানে সহায়ক হয় তবে আমরা উপকৃত হব। প্রযুক্তি তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেওয়ায় ক্ষীণ হলেও একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সামনের দিনগুলোই যদি এই প্রতিযোগিতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে তখন ময়দানে দেখা যাবে পণ্য, মুদ্রা, প্রযুক্তি ও ধারণার লড়াই। এ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জেতে তা-ই এখন দেখার অপেক্ষায়!
তবে এই মুহূর্তে পৃথিবীর রং তামাশা বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। কেউ না খাওয়াইয়ে মারছে, কেউ না খেয়ে মরছে। এক দিকে করোনা মহামারি, অন্য দিকে যে কোন সময় বিশ্বযুদ্ধ বাধার সম্ভবনা উক্রাইনকে নিয়ে।
চলছে বৈঠকের পর বৈঠক। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন রাশিয়া তার ঘরের পাশে ন্যাটো সামরিক জোটের নতুন কোনো তৎপরতা কোনোভাবেই সহ্য করবে না। আমেরিকা এবং ন্যাটো জোট রুশের এই বার্তা অগ্রাহ্য করলে ইউরোপকে আবারো "যুদ্ধের দুঃস্বপ্ন" দেখতে হতে পারে। সুইডেন, ফিনল্যান্ড তাদের সীমন্তে সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ দিয়েছে। জনগণের মধ্যে কিছুটা আতঙ্কের ছাপ পড়েছে।
সমস্থ সমস্যা মিলে ক্রাইসিস সিসুয়েশন, ঠিক তেমন একটি সময় রাশিয়ার হুঁশিয়ারি সংকেত ‘ইউরোপ আক্রমণ’ এই হচ্ছে বিশ্বের তথা ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতি। Hello Bangladesh, tell me how are you doing?
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com