গতকাল শুক্রবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সাইফুলকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এই গাড়ির কোনো কাগজপত্র নেই। ২০১৮ সালের পর এই গাড়ির নথিপত্র হালনাগাদ করেনি। ঘটনার সময় কুয়াশা ছিল। গাড়িটি চলছিল ৬৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিতে। কুয়াশার কারণে চালক কাউকে দেখতে পায়নি।
এ কারণে রাস্তা পারাপারের জন্য অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের ওপর গাড়ি তুলে দেয়। র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, চালক জানিয়েছে, দুর্ঘটনার পর সে গাড়ি থেকে নেমে ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু মালিকের ছেলে তারেক, চালককে ঘটনাস্থল থেকে পালাতে বলে। আহতদের হাসপাতালে না নিয়ে তারা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
গাড়ির মালিক চালককে এক বছর লুকিয়ে থাকতে বলে কারণ তার মতে এটা হবে একটি সরকারি মামলা। চালক সাইফুল দুই বছর ধরে গাড়ি চালালেও তার কোনো লাইসেন্স ছিল না জানিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, চালক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালিয়েছে।
কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলা অংশের মালুমঘাট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এখানে আমার শুধু একটি প্রশ্ন, চালক বিনা লাইসেন্সে দুই বছর গাড়ি চালাচ্ছে দেশের মহাসড়কে অথচ পুলিশের নজরে বিষয়টি কি একবারও পড়েনি? নজরে পড়েনি নাকি নজরে যাতে না পড়ে তেমন চুক্তি পুলিশের সঙ্গে চালকের মালিকের চয়েছে, খুব জানতে ইচ্ছে করে!
প্রিয়জনকে হারানো যে কী কষ্টের তা বোঝানো যাবে না। বোঝানো যাবে না সন্তান সকালে স্কুলে গিয়ে বিকেলে লাশ হয়ে ফিরে আসার কষ্ট। বোঝানো যাবে না আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে এসে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী ও সন্তান হারানো আয়েশা রহমান সিদ্দিকার কষ্টের কথা।
এ ধরণের মর্মান্তিক দৃশ্য ও ঘটনা হয়তো দেশের মানুষের সয়ে গেছে। কারণ প্রতিদিন এধরণের ঘটনা ঘটে চলছে সারাদেশে। ভাবতেই গা শিহরে উঠছে। মা-বাবার কোলে সন্তানের অকাল মৃত্যুর চেয়ে বড় কষ্ট জীবনে আর কী হতে পারে! যারা প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করছে তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
বাংলাদেশের সড়ক ভীষণ মাতাল ও মানুষখেকো। রাস্তার ইট, বালি, সিমেন্ট, রড থেকে শুরু করে ভাঙ্গা ও অনিরাপদ যানবাহন এবং তার চালকদের মনিটরিং করার মতো দায়িত্বশীল লোক দেশে নেই। সবার ভাবটা এরকম যে, যা মরে মরুক, যা থাকে থাকুক। সবকিছুই আজ দুর্নীতি ও রাজনৈতিক মেরুকরণের কবলে আচ্ছাদিত। দেশের মানুষগুলোর জন্য মায়া হয় কেননা তারা নিরাপদ সড়ক নিয়েও মুখ খুলতে পারে না। জনগণকে নিরাপদে রাখা যাদের দায়িত্ব, তারা ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে নিজের সন্তানের এহেন টুকরো লাশ দেখেও চুপ করে থাকে। বলতে ইচ্ছে হয়, ‘তোরা মানুষ হ’। কেননা এই বেহুশ মানুষগুলোর মানবিক দিকগুলো উন্মোচিত না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চোখের সামনে হারাতে হবে শত শত সন্তানকে।
এখন আমি যেহেতু সুইডেনে বসবাস করি বলবো সেখানকার কথা। বরফের দেশ সুইডেনেও ট্রাফিকের কবলে পড়ে মাঝে মাঝে মানুষের জীবন চলে যায়। তারপর মাদকাসক্ত হয়ে অনেকে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। পৃথিবীর সর্বত্রে ট্রাফিক দুর্ঘটনা ঘটে সত্য তবে বাংলাদেশের বিষয়টি অত্যন্ত অমানবিক এ বিষয়টি নিশ্চিত। একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমার এক সুইডিস বন্ধু নাম নিকলাস, আইটি কোম্পানির মালিক। তার ব্যস্ততার সময় ৩০ কিমি/ঘণ্টার রাস্তায় সে ৫০কিমি/ঘণ্টায় গাড়ি চালাতেই পুলিশের ল্যান্সে ধরা পড়ে। এ ধরনের অপরাধে এক মাস গাড়ি চালানো নিষেধ। বন্ধু তার অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং রেফারেন্স দিয়ে পরিচয় দেয় যে তার বন্ধু স্টকহোম জেলার পুলিশ সুপার, তাকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। পুলিশ এ কথা শোনার পরে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স তৎক্ষণাৎ বাতিল এবং ১০ হাজার ক্রোনার জরিমানা করে।
পুলিশকে ভয় দেখানো ও ক্ষমতার অপব্যবহার করার কারণে এমন শাস্তি তাকে পেতে হয়েছিল। পুলিশের সৎ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কারণে দুর্নীতি পরাজিত হয়েছিল সেদিন। ট্রাফিকের নিয়ম ভঙ্গ করা বা রেড লাইটের সিগন্যাল না মানা মাঝেমধ্যে হয়ে থাকে কমবেশি পৃথিবীর সবখানে। মানসিক বিকারগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত, অপরাধী, অসচেতন যেই হোক না কেন ধরা খেলে জরিমানা সঙ্গে লাইসেন্স বাতিল হওয়াটা নির্ভর করে পৃথিবীর কোন দেশে ঘটনাটি ঘটেছে তার ওপর। যেখানেই ঘটুক না কেন শাস্তি সব জায়গাতে এক কিন্তু বাংলাদেশে এটা একেবারেই বলতে গেলে অন্যরকম। কারণ একটাই তা হলো, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা এবং দুর্নীতিযুক্ত ব্যবস্থাপনা। ঘুষ দিয়ে যদি অন্যায়কে ঢাকার সুযোগ থাকে তবে তা পৃথিবীর সর্বত্র ট্রাফিকের নিয়মকানুনের লঙ্ঘন ঘটাতে পারে।
কিন্তু তা সবখানে সম্ভব নয় বিধায় সবাইকে ট্রাফিকের নিয়ম মেনে চলতে হয়। বাংলাদেশে কি আদৌ রেড সিগন্যাল বা রাস্তার গতি মেনে চলা হয়? না মানার কারণ কী হতে পারে তা আমার উপরের বর্ণনায় পরিষ্কার। দেশে বেশির ভাগ ক্ষমতাশীল লোক তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা তারা ঘুষ দিয়ে এ ধরনের ক্রাইম থেকে সচরাচর মুক্তি পেয়ে থাকে। নিয়ম ভঙ্গ করা নতুন কিছু নয় তবে শাস্তি না পাওয়া বা যদি ঠিকমতো শাস্তি দেয়া না হয় তখন তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। বাংলাদেশে যারা যানবহন চালান তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শুধুমাত্র প্লেনের পাইলটদের ভালো প্রশিক্ষণ দিলেই কি মানব জাতির জীবনের গ্যারান্টি আসবে? যারা অনিয়ম করে গাড়ি চালায় এবং প্রতিটি গাড়িতে কম করে হলেও ১০০ জন যাত্রী থাকে।
যখন অসতর্কতার কারণে এক্সিডেন্ট ঘটে তখন কতগুলো জীবনশেষ হয় তা বলার প্রয়োজন আছে কি? প্লেনের পাইলট আর গাড়ির চালকের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য দেখতে পারি যদি অসতর্কতার কারণে এক্সিডেন্ট ঘটে? আমি মনে করি দেশের সকল মানুষকে ম্যুরাল ভ্যালু ও ঘুষমুক্ত সুপ্রশিক্ষণ দিতে পারলেই তৈরি হবে রেসপেক্ট ও দায়িত্ববোধ। যে জাতি ট্রাফিকের সিগন্যাল অমান্য করে সে জাতির দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না। যেদিন জাতি এই ছোট একটি পরীক্ষায় পাস করবে, শুধু ট্রাফিকের সিগন্যালের ওপর রেসপেক্ট দেখিয়ে, সেদিন প্রমাণিত হবে সোনার বাংলায় লাল সবুজের পতাকার জয় হয়েছে, সেই সঙ্গে মানবতারও। ট্রাফিক সিগন্যালের ওপর রেসপেক্ট দেখানো মানে জাতি মানবতার ওপর রেসপেক্টের পরিচয় দিতে শিখেছে ভাবা যাবে।
সব সময়ই দেখি যেমন আগুন লাগলে পানি দিয়ে সে আগুন নেভানো হয়, অনেক সময় পর্যাপ্ত পানির অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব হয়না। কিন্তু ইদানীং পানির ওপর লঞ্চ পুড়ে অর্ধশত মানুষের মৃত্যু, লক্ষ লক্ষ টন পানি থাকা সত্ত্বেও সে পানি কাজে লাগেনি, আশ্চার্য! গত কয়েকদিন আগে বাল্টিক সাগরের মধ্যে জাহাজে আগুন লাগে, কেও মারা না গেলেও জানা গেছে মাদকাশক্ত এবং অসাবধানতার কারণে জাহাজে আগুন লাগে। বাংলাদেশের লঞ্চে আগুন লাগার পেছনে নিশ্চিত ট্রাফিক আইন লঙ্ঘণ জড়িত। সেটা হতে পারে অসাবধানতা, হতে পারে সঠিক ভাবে যান্ত্রিক রক্ষণাবক্ষণ না করা বা অন্য কোন অজানা তথ্য জড়িত। পানি থাকা সত্ত্বেও পানিতে যেমন লঞ্চ পুড়ে মানুষ মরছে ঠিক রাষ্ট্রের দায়ীত্বে থাকা দায়ীত্বশীল কর্মী এবং যথেষ্ট রিসোর্স থাকা সত্ত্বেও তার সঠিক এবং গ্রহনযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এ ধরণের দুর্ঘটনা এবং মূলত রাষ্ট্রই এর জন্য দায়ী। রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হচ্ছে নাগরিকের জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শুধু শাসন-শোসন এবং ভাষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করাই যদি সরকারের কাজ হয় তাহলে শুধু ট্রাফিক নয় তিলে তিলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের সেতু, সড়ক, এবং পরিবহন মন্ত্রীকে অনুরোধ করছি সারাদিন বসে বসে বিরোধীদলের বদনাম না ছড়িয়ে বরং অনতিবিলম্বে উন্নত ট্রাফিক ব্যবস্থা, সুপরিসর রাস্তা নির্মাণ করার কাজে মনোযোগী হোন এবং বিছানার চাদর ও বালিশের কভারে ব্যবহৃত উপকরণের মান যাচাইয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শকে জার্মানিতে না পাঠিয়ে বরং দেশের আইন শৃংখলা সঠিক ভাবে পালন করতে নির্দেশ দিন। (আইজিপি সাহেব কি কোয়ালিটি কন্ট্রোলার না রং বিশেষজ্ঞ? উনি কি কেমিস্ট? এগুলোর পরীক্ষা করে বাংলাদেশে Intertek bd ltd, SGS, BV সহ আরো অনেকে এবং সফলতার সাথে করে। বেনজির সাহেব কি করবেন এখানে?) দেশের সকলের প্রতি অনুরোধ আইন মেনে চলার আন্তরিকতা গড়ে তুলুন, প্লিজ।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।rahman.mridha@gmail.com