জমা স্লিপের ছবি তুলে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে আব্দুস সালামের কাছে পাঠিয়ে দেন আব্দুল গণি। ব্যাংকের হিসাব যাচাই না করেই সরল বিশ্বাসে পণ্য সরবরাহ করেন আব্দুস সালাম। দুদিন পার হওয়ার পরও ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা না হওয়ায় ক্রেতার স্মরণাপন্ন হন তিনি। জমা স্লিপের ছবি দেখিয়ে টাকা জমা দেয়ার দাবি করেন ঐ ক্রেতা।
ব্যাংকের মূল শাখার স্মরণাপন্ন হন আব্দুস সালাম। ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের কাছে হাজির করা হয় এজেন্ট এবং জমাদানকারীকে। বেরিয়ে আসে ভিন্ন ঘটনা। ব্যাংকের এজেন্ট ঐ গ্রাহকের পূর্ব পরিচিত। অনলাইনে ব্যাংকের হিসাবে টাকা জমা করে কম্পিউটারে এজেন্ট গ্রাহককে ভাউচার দেবেন। এই নিয়ম লংঘন করে তিনি ব্যাংকের স্লিপে টাকা জমা নেন। গ্রাহক টাকা জমা দেয়ার কিছুক্ষণ পরই এসে এজেন্টকে বলেন আমি টাকাটা জমা দিতে চাই না। টাকা ফেরত চাই। এজেন্ট উক্ত জমা স্লিপ ফেরত নিয়ে ছিড়ে ফেলেন এবং গ্রাহকের টাকা ফেরত দেন।
এক্ষেত্রে এজেন্ট দুটি অপরাধের সাথে জাড়িয়ে পড়েন। প্রথমত তিনি নিয়ম লংঘন করে ব্যাংকের স্লিপে টাকা জমা করেন। দ্বিতীয়ত গ্রাহক চাওয়া মাত্র টাকা ফেরত দেয়া। এই সময়ে গ্রাহক উল্লেখিত জমা স্লিপের ছবি দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতার সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে গ্রাহককে জালিয়াতিতে সহযোগিতা করেছেন। এজেন্ট কেন্দ্রে নিয়ম লঙ্ঘন ও প্রতারণার এটি একটি উদাহরণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভূক্তিমূলক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে এজেন্ট ব্যাংকিং। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্থিক সেবা সুবিধা বঞ্চিত মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছাতে এজেন্ট ব্যাংকিং দৃশ্যমান সফলতা অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশের ২৯ টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ১৯ হাজার ২৪৭ টি আউটলেট পরিচালনা করছে প্রায় ১৪ হাজার এজেন্ট। ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ায় শাখা বা উপশাখার চেয়ে এজেন্ট নেটওয়ার্ক বিস্তারে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক সফলতার পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনায় এজেন্টদের ব্যাংকিং নিয়ম কানুন পরিপালনগত দুর্বলতার কারণে সুনাম হারাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবসা অনেকের কাছেই এখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। অনেকেই হন্যে হয়ে ছুটছেন ব্যাংকগুলোর দোরগোড়ায় এজেন্সি নেয়ার জন্য। ব্যাংকের এজেন্সিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে ব্যাংকের মালিক বলে প্রচারণা চালানো হয় বলে জনশ্রুতি আছে।
ব্যাংক বহির্ভূত ব্যবসায়ী বা বেকাররাই এজেন্সির মালিক হয়ে থাকেন। ব্যাংকিংয়ের অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই তারা হয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকের মালিক। হঠাৎ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার কাজ পেয়ে অনেকটা লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েছেন অনেক এজেন্ট। গ্রাহকের টাকা ব্যাংকের হিসাবে জমা না করা, গ্রাহকের কোটি টাকা আত্মসাত করে এজেন্ট উধাও, অংশিদারিত্ব ও লভ্যাংশ নিয়ে দ্বন্দ, মোটা অংকের টাকা নিয়ে এজেন্সিতে কাজ দেয়া, কর্মচারিদের হয়রানি, নারী গ্রাহকদের ছবি ও তথ্য ব্যবহার করে হয়রানি, এজেন্সির নাম ব্যবহার করে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার খবরও বেরিয়েছে সংবাদ মাধ্যমে।
নিজেদের আর্থিক শক্তি বিবেচনা না করেই এজেন্সি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন অনেকে। গ্রাহকের বড় অংকের টাকা জমা, ট্রান্সফার বা পেমেন্ট দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অভিজ্ঞতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের অভাবে গ্রাহক সংকট ও ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হতাশ হয়ে এজেন্সি সারেন্ডারও করছেন কোন কোন এজেন্ট।
তবে এজেন্টদের পক্ষ থেকেও গ্রাহক সেবার মান বাড়াতে নানাবিধ অসুবিধার কথা যানা যায়। ব্যাংকের ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় গ্রাহকদের টাকা জমা, উত্তোলন এবং অন্যান্য তথ্য ও সেবা পেতে দেরি হওয়ায় সেবার মান ও ব্যবসায়িক উন্নয়ন করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ন্যূনতম পরিবেশ তৈরি না করেই ব্যাংকিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ এ সেবা যত্রতত্র ও অপেশাদার ব্যক্তি দিয়ে করানোর মতো খবরও পাওয়া যায়। কোন কোন ব্যাংক মোবাইলের ফ্লেক্সি লোড দোকানদার, মুদিখানার কর্মচারি ও ওষুধ বিক্রেতাসহ বিভিন্ন পেশার লোকদের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালিয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে টাকা পাঠানোকেই প্রধান কাজ মনে করছে কোনো কোনো এজেন্ট।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিনিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিনিয়োগ কার্যক্রমে অভিজ্ঞতা না থাকা এবং দক্ষ জনবলের অভাবে অনেক এজেন্টই গ্রাহক নির্বাচন ও বিনিয়োগ পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ কেউ এনজিও স্টাইলে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ফলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক নয়। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এযাবত আসা ২৪ হাজার ৫৫ কোটি টকা আমানতের বিপরীতে বিনিয়োগ হয়েছে ৩৮৩৬ কোটি টাকা যা আমানতের ১৬ শতাংশ। তবে আলাদাভাবে গ্রামে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক কম। গ্রামের আমানত স্থানীয় পর্যায়ে বিনিয়োগ না হওয়ায় তা শহরে বিনিয়োগ হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনয়নে গ্রামে বিনিয়োগ বাড়াতে এজেন্ট বাংকিং পরিচালনাকারী বাংকগুলোর প্রতি তাগাদা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকাররা চেষ্টা করছেন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগে জটিলতা কাটিয়ে ওঠার।
প্রতারণা ও আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে ব্যাংক ও এজেন্ট উভয়েরই প্রয়োজন সতর্ক পদক্ষেপ। প্রতিযোগিতা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের এই সময়ে এজেন্সি দেয়ার আগে ব্যাংকগুলোকে ব্যক্তির চরিত্র, ব্যবসায়িক সুনাম ও আর্থিক সক্ষমতা যাচাই করা খুবই জরুরি। অন্যদিকে ব্যাংকের এজেন্ট হওয়ার পূর্বে নিজের সক্ষমতা ও ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাই, এজেন্সি ব্যবসা পরিচালনা করতে ব্যাংকের নিয়ম কানুনসমূহ জানা ও তা পরিপালন করা এজেন্টের প্রধান দ্বায়িত্ব। অন্যথায় উভয়ের আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অর্থ লেনদেন, পন্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের খরচ কমানো, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, গ্রাম বাংলার উন্নয়ন ও এনজিও এবং মহাজনী সুদের শোষন থেকে তৃণমূল জনগোষ্ঠীকে উদ্ধার করতে এজেন্ট ব্যাংকিং প্রভূত সম্ভাবনাময় একটি খাত। এ খাতের উন্নয়নে এজেন্টদের জন্য ব্যাংকিং ব্যবসা শুরুর আগে ও পরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের এজেন্ট করা, এজেন্টদের যথাযথ মনিটরিং ও সুপারভিশনের ব্যবস্থা করা এবং তাদের জন্য যথাযথ নিয়ম কানুন প্রণয়ন ও প্রযুক্তি সেবা উন্নয়নের মাধ্যমে এ খাতকে সমৃদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি।