নিজ কর্মীদের বেতন-ভাতা না কমানোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক। কর্মীদের চিঠি দিয়ে এরই মধ্যে বিষয়টি জানিয়েছেন নবীন ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী তারিকুল ইসলাম চৌধুরী।
বেতন-ভাতা না কমানোর আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসরকারি খাতের অন্যতম মার্কেন্টাইল ব্যাংকও। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত হলেও বেতন-ভাতায় হাত না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিএবির প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার পক্ষে হাঁটছে প্রাইম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংকসহ অনেক বেসরকারি ব্যাংক।
কর্মীদের বেতন-ভাতা না কমানোর পক্ষে থাকা ব্যাংকগুলোর পরিচালক ও কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জন ব্যাংক কর্মকর্তা মারা গেছেন। আক্রান্ত কর্মীদের সংখ্যাও হাজার ছাড়িয়েছে। তার পরও ব্যাংকাররা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন ব্যাংকে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানো হলে সেটি হবে অবিচার।
এ প্রসঙ্গে এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের সেবা দিয়ে আসছেন। করোনা দুর্যোগে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে ফ্রন্টলাইনার যোদ্ধা হিসেবে ব্যাংকারদের মনোবল ধরে রাখা প্রয়োজন। এজন্য এসবিএসি ব্যাংক পর্ষদ কর্মকর্তাদের বেতন না কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সঙ্গে একমত মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কোনো না কোনো ব্যাংকারের মৃত্যুর সংবাদ শুনতে হচ্ছে। শত শত ব্যাংক কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। বাড়িতে কিংবা হাসপাতালে অক্সিজেন নেয়ার জন্য হাহাকার করছেন। এ অবস্থায় কেউ যদি শোনে তার বেতন ১৫ শতাংশ কমে গেছে, তার চেয়ে অমানবিক কোনো সংবাদ হতে পারে না। এজন্য মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এখনই কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোর পক্ষে নয়।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএবি যে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে, তার মধ্যে কিছু সুপারিশ সাংঘর্ষিক। যেকোনো ব্যাংক নিজের ব্র্যান্ডিংয়ের স্বার্থে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতেই পারে। কিছু বিজ্ঞাপন দেয়ার বিষয়ে আইনি বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। এ অবস্থায় বিএবি যে প্রস্তাব করেছে, তা অযৌক্তিক।
প্রসঙ্গত, ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতন-ভাতা পান এমন কর্মীদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কমানোর সুপারিশ করে সম্প্রতি দেশের সব বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। চিঠিতে কর্মীদের পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট, ইনসেনটিভ বোনাস বন্ধ করাসহ ১৩ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এ চিঠি দেয়ার আগেই কর্মীদের বেতন-ভাতার ১০ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় দ্য সিটি ব্যাংক। একই সঙ্গে কর্মীদের পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট ও ইনসেনটিভ বোনাস বন্ধের সিদ্ধান্তও নেয় ব্যাংকটি। তারও আগে গত মে মাসের মাঝামাঝিতে কর্মীদের বেতন-ভাতা ৩ ও ৫ শতাংশ কর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় এবি ব্যাংক। বিএবি থেকে চিঠি দেয়ার এক দিন পরই কর্মীদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কর্তন, পদোন্নতি ও ইনক্রিমেন্ট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এক্সিম ব্যাংক পর্ষদ। একই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে হাঁটছে দেশের আরো অন্তত ১০টি বেসরকারি ব্যাংক।
বেতন-ভাতা কমানোর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে চলমান নিয়োগসহ সব নিয়োগ বন্ধ রাখার সুপারিশও করেছে বিএবি। এছাড়া নতুন শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও উপশাখা খোলা বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে সংগঠনটি। বিএবি বলেছে, করোনাভাইরাস সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মী ছাঁটাই না করে ব্যাংককে সচল রাখার জন্য নির্দেশনাগুলো দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সুপারিশ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
১৩ দফা সুপারিশসংবলিত চিঠিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে আরো যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সব ধরনের স্থায়ী সম্পদ ক্রয় বন্ধ রাখা, কর্মীদের লোকাল ও বিদেশী প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখা, সব বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখা, সব ধরনের সিএসআর, ডোনেশন, চ্যারিটি বন্ধ রাখা, পত্রিকা (প্রিন্ট ও অনলাইন) ও টেলিভিশনে সব ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদান বন্ধ রাখা, সব কাস্টমার গেট টুগেদার বন্ধ রাখা।
চিঠিতে বিএবি বলেছে, কর্মকর্তাদের গেট টুগেদার ও ব্যবস্থাপক সম্মেলন বন্ধ থাকবে। প্রয়োজনে এসব সম্মেলন ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে নিজস্ব পরিমণ্ডলে করতে হবে। এছাড়া বড় ধরনের ব্যয় (আইটি সম্পর্কিত, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ক্রয়) আপাতত সীমিত রাখা এবং অন্য সব ব্যয় কমিয়ে আনা।
বিএবির চিঠিতে ব্যাংকারদের বেতন-ভাতা কমানো, নতুন নিয়োগ বন্ধসহ অনেক অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও পরিচালকদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যয়ের একটি বড় অংশ পরিচালক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পেছনে অপচয় হয়। কিন্তু বিএবির চিঠিতে এ নিয়েও কোনো কথা বলা হয়নি। বলা হয়নি, পরিচালকদের পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণের বিনিময়ে প্রাপ্ত সম্মানীর বিষয়েও। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেক ব্যাংকের পরিচালক ও শীর্ষ ব্যাংকাররা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন পরিচালক বলেন, বিএবি সদস্য ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান নয়। যে ১৩ দফা সুপারিশ বিএবি করেছে, তার বেশির ভাগের বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার সংগঠনটির নেই। সব ব্যাংকের আর্থিক সামর্থ্য ও পরিবেশ এক নয়। সব ব্যাংকের কর্মীদের বেতনকাঠামোও সমান নয়। ব্যাংকের যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদের। আমাদের সিদ্ধান্ত হলো ব্যাংকের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাব, কিন্তু কর্মীদের বেতন-ভাতা নয়।
একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএবির উচিত ছিল ব্যয় কমাতে পরিচালকদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলা। নিজ ও অন্য ব্যাংক থেকে নেয়া ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়ে তাগিদ দেয়া। অন্তত দুই বছর ব্যাংক থেকে মুনাফা না নেয়ার ঘোষণা দেয়া। কিন্তু বিএবি এসব বিষয়ে কিছু বলেনি। উল্টো এমন সব বিষয়ে কথা বলেছে, যে বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার এখতিয়ারই সংগঠনটির নেই।