জাতিসংঘের অবদানের জন্যই হোক বা মানবতার তাগিদেই হোক সারা বিশ্ব এখন এক পরিবারের মত। সব ক্ষেত্রে না হলেও খাদ্য বিষয়ক সমস্যার বিষয়ে। বিশ্বের কোথায়ও কেউ যেন মারা না যায় খাদ্যের অভাবে, সে লক্ষ্যে কাজ চলছে নিরন্তর। আশার কথা যে, ১৯৬৪-৬৫ সালের তুলনায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা অনেক ভাল তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তুলনায় যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল দেশ থেকে দরিদ্রতা বিমোচনের মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশ প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকে শহীদ হয়েছেন। বর্তমানে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মাসিক সম্মানি দিতে পারছেন সরকার, কিন্তু শহীদদেরকে? দেশের আপামর মানুষের জন্য সুখী-সমৃদ্ধিশালী সমাজ উপহার দিতে শহীদদের আত্মার কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন নিজেদের মঙ্গলের জন্য নয়। তাঁরা যুদ্ধে গিয়েছিলেন পরবর্তি প্রজন্মকে সুথী দেখতে, পরোক্ষ প্রতিদানের জন্য।
স্বাধীনতার ৪৮ বছরের মাথায় বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায় সার্বিক অবস্থা আরো ভালো হওয়া উচিৎ ছিল। ১৯৭১ সালে এ অঞ্চলে মানুষের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি আর ২০২০ সালের সূচনায় ১৭ কোটি, তার মধ্যে প্রায় ৪ কোটি মানুষের দৈনিক আয় ১.৯০ মার্কিন ডলারের কম অর্থাৎ ২০০.০০ টাকার কম। বর্তমান বাজার দর বিবেচনায় নিয়ে সহজেই অনুমান করা যায় তাদের দৈনিক খাদ্য তালিকায় কী থাকতে পারে; তাদের সন্তানদের শিক্ষার প্রসার কেমন হবে। আর এ কারণেই হয়ত ১ কোটির বেশি মানুষ শ্রমিকের চাকুরী নিয়ে বিদেশে পারিবারিক জীবন থেকে বঞ্চিত। সরকারের পরিকল্পনায় আছে দেশের মানুষের খাদ্য, চিকিৎসা এবং শিক্ষার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা। কাজ করে যাচ্ছেনও কিন্তু আশাপ্রদ সুফল আসছে না। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানেও উল্লেখ আছে যে, দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা যথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সরকারকে পূরণ করতে হবে। সম্প্রতি এক সংবাদে প্রকাশ প্রতি বছর দেশে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ সম্পদহীন হয় চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে। শিক্ষার মান এবং হার-তাও তথৈবচ। মাত্র কয়েকদিন আগে প্রকাশিত প্রাথমিক এবং জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় পল্লী এলাকার স্কুলের ফলাফল ভালো না। শহরের মানুষ নাগরিক সুবিধা না পেলেও তাদের একটি বড় অংশ সন্তানের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে পারেন যে কোন কারণেই হোক।
বিশ্ব এখন খুব দ্রুত বিজ্ঞান এবং যন্ত্র নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের স্বার্থে সরকারের কাজ ব্যবসার আওতায় চলে যাচ্ছে। অবস্থার বিবেচনায় সাধারণ মানুষ খুব সহজেই ব্যবসায়ীদের আওতায় চলে যাচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে ব্যক্তির উপার্জন নির্ভর করছে নিজ নিজ সক্ষমতা বা কর্মক্ষমতার উপর। সরকারের উচিৎ সাধারণ মানুষকে শিক্ষীত করে প্রতিযোগীতার বাজারে কর্মক্ষম হতে সাহায্য করা। সরকার যদি সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন না করে তাহলে সমাজে বৈষম্য আরো বেড়ে যাবে। সমাজ পরিবর্তনে সরকারের কাজ আসল। শিক্ষা খাতের উন্নতির জন্য সরকারের সব খাতের সম প্রচেষ্টা দরকার। সরকারের দীর্ঘদিনের চেষ্টার পরও ২০১৯ সালে সরকারের উন্নয়নের অংশিদার বিম্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের “Half of population still vulnerable to poverty” (দৈনিক নিউ এজ, তারিখ ০৮ অক্টোবর, ২০১৯)। বিশ্বব্যাংকের “Bangladesh Poverty Assessment” শীর্ষক প্রতিবেদনে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়েছে (দৈনিক প্রথম আলো, ০৮/১০/২০১৯)।
দেশে মেগা প্রকল্পের উন্নয়ন কাজের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য সরকারের পরিকল্পনা মাফিক সকল পরিসেবা যেন সাধারণ মানুষ পায় তার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ মানুষের উন্নতি হলেই দেশের উন্নয়ন হবে টেকসই। সরকারের হিসাবে গড় হিসাব খুব সহজেই প্রয়োগ হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে গড় হিসাব প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে না। ২ যোগ ১০০ এর গড় হবে ৫১, যা দু’জনের প্রকৃত বাস্তব অবস্থা নয়।
আমার মত মানুষ যারা ১৯৭১ সালে জীবনের প্রথম সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করে সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখার জন্য, তাদের সেই আশা বাস্তবায়নের অন্যথা হওয়া উচিৎ নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তি। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারনের যে অংশটি এখনও দারিদ্রের বিষচক্রে আবদ্ধ তাদেরকে বের করে আনতে হবে আর তাহলেই একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যাশা পূরণ হবে।
হায়দার আহমদ খান এফসিএ
চেয়ারম্যান
এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন-ইডিএ