বেসরকারি তিন ব্যাংক থেকে ৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে নাবিল গ্রুপ। এর মধ্যে শুধু সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকই প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দিয়েছে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা। এ অর্থ আইন লঙ্ঘন করে দেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে এই ঋণকে ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বেনামি ঋণ হিসেবে সন্দেহ করা হয়েছে। আবার একই গ্রুপের নামে এই পরিমাণ ঋণ, ব্যাংক কোম্পানি আইনে থাকা একক গ্রাহকের অনুকূলে দেওয়া ঋণ সীমার (সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার লিমিট) চেয়ে বেশি। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলোকে ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৩০ মে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ড সভায় গুলশান শাখা থেকে নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফীড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামের ১ হাজার ১২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ফান্ডেড (নগদ) ৪৫০ কোটি এবং নন ফান্ডেড (এলসি ও ব্যাংক গ্যারান্টি) ৬৭০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ সীমা নতুনভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনখাতে এই টাকা ব্যবহার হবে তা উল্লেখ নেই। কোন বিবেচনায় নতুন একজন গ্রাহককে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হলো তা যাচাই করা জরুরি বলে মনে করে বাংলাদেশে ব্যাংক।
সূত্র জানায়, ব্যাংকটির ৪৮১তম বোর্ড মিটিংয়ে ঋণ অনুমোদন দেওয়া হলেও ৪৮২ এবং ৪৮৩তম বোর্ড সভায় শর্ত শিথিল করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাক্তিগত গ্যারান্টির ক্ষেত্রে সকল পরিচালক এবং তাদের স্বামী/স্ত্রীর গ্যারান্টি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে শর্ত শিথিল করে শুধু পরিচালকদের গ্যারান্টি রাখা হয়। আমানত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল নিজ নামে অথবা রেফারেন্সে অন্যদের নামে প্রাথমিকভাবে ২শ কোটি এবং পরবর্তীতে আমানত ৬শ টাকায় উন্নীত করতে হবে। কিন্তু পরে তা শিথিল করে বলা হয়, পর্যাপ্ত আমানত রাখতে হবে। এই পর্যাপ্তের কোনো ব্যাখা দেওয়া হয়নি। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, একটি নতুন ঋণের ক্ষেত্রে কোন বিবেচনায় শর্ত শিথিল করা হলো তা জানা জরুরি। এছাড়াও গ্রাহক বেনামে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানটি কিনা সেটিও যাচাই করতে হবে।
গুলশান শাখার নতুন গ্রাহক নাবিল গ্রেইন ক্রপসের অনুকুলে ৯৫০ কোটি টাকা নন ফান্ডেড ঋণ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে এই ঋণে ২৩০ কোটি টাকা জামানত হওয়ার কথা। ঋণের শর্তে ১১০ কোটি টাকার আমানত অথবা লিয়েন থাকার কথা বলা হয়েছে। এক জায়গায় বলা আছে, কৃষিপণ্য আমদানি ও বিপনের জন্য এই অর্থ ব্যবহার হবে। কিন্তু সর্বশেষ সিআইবি প্রতিবেদন অনুসারে বিভিন্ন ব্যাংকে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের মোট এক্সপোজার মাত্র সাড়ে ৮ লাখ টাকা। প্রকল্পঋণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে গ্রাহক একেবারে নতুন। ফলে সম্পূর্ণ নতুন একজন গ্রাহককে বাণিজ্যের জন্য এই পরিমাণ ঋণ দেওয়া হলো। এক্ষেত্রে গ্রাহকের বড় ব্যবসা পরিচালনার দক্ষতা এবং অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়েছে কিনা তা যাচাই করা দরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অর্থসংবাদকে বলেন, ব্যাংক যদি আইন লঙ্গন করে লোন দিয়ে থাকে সেটা তাদের বিষয়। কিন্তু আমরা দীর্ঘ দিন ব্যবসা করছি, আমরা সব কিছুর নিয়ম মেনেই লোন নিয়েছি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাফর আলম বলেন, তিনি মিটিংয়ে আছেন পরে কথা বলবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ফোন রেখে দেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো ব্যাংক একক কোনো প্রতিষ্ঠানকে ফান্ডেড এবং নন ফান্ডেড মিলিয়ে তার পরিশোধিত মূলধনের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। এর মধ্যে ফান্ডেড ১৫ শতাংশ এবং নন ফান্ডেড ২০ শতাংশ। আর বর্তমানে এই তিন ব্যাংকের মোট পরিশোধিত মূলধন ৩ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে গ্রুপটিকে ১ হাজার ৩শ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। কিন্তু দেওয়া হয়েছে তার প্রায় ৫গুন বেশি।
নাবিল গ্রুপের ওয়েব সাইটে গ্রুপটির ১৭টি প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- নাবিল নব ফুড, ফ্লাওয়ার মিল, ফিডমিল, অটোরাইস মিল, ডাল মিল, কনজুমার প্রোডাক্ট, নাবিল ফার্ম, ক্যাটল ফার্ম এবং নাবিল ট্রান্সপোর্ট উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই ওয়েব সাইটে প্রোডাক্ট অপশনে মাত্র ৬টি পণ্যের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- চাল, আটা, ময়দা, সুজি, ডাল এবং পশুখাদ্য। কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মো. জাহান বক্স মন্ডল, পরিচালক ইসরাত জাহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম এবং উপ পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ।