বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্টের বোস্টন ক্যাম্পাসের সৈয়দ ফয়সাল আরিফ গত জানুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দাঁতমারা ইউনিয়নের কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ফয়সালকে হত্যার পর থেকেই তার পরিবার পুলিশকে অভিযুক্ত দাবি করে তদন্ত চেয়ে আসছে। কিন্তু ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও বিচার নিয়ে কোনো কিছুই দেখতে পায়নি পরিবারটি।
সন্ত্রাসীদের গুলিতে চলতি বছর আরেক বাংলাদেশি রমিম উদ্দিন আহম্মেদ প্রাণ হারিয়েছেন। রমিমের বাড়িও চট্টগ্রামে; মিরসরাই করেরহাট ইউনিয়নে। ২০২১ সালেও গুলিতে এক বাংলাদেশি যুবক নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপের দাবিতে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে বিক্ষোভ। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তাদের শোক প্রকাশ করেছে। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস সম্প্রতি মিসৌরি রাজ্যে এক বাংলাদেশি যুবকের হত্যার ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে।
শুক্রবার দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, "আমরা বাংলাদেশের ২২ বছর বয়সী এক ছাত্রের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাতে চাই, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইস, মিসৌরিতে একটি আপাত ডাকাতির ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে মারা গেছেন"।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন অন্তত তিনজনকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে পুলিশের হাতে। চলতি জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ছয় মাসেই দেশটিতে দুই বাংলাদেশিসহ অন্তত ৬০২ জন পুলিশি সহিংসতায় নিহত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি সহিংসতা নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স ২০১৩ সাল থেকে দেশটিতে পুলিশের হাতে নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করে আসছে। সংস্থাটির প্রতিবেদনের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, দেশটিতে ২০১৩ সালের পর থেকে সবচেয়ে বেশি পুলিশের হাতে প্রাণ হারিয়েছে গত বছর। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ জন করে প্রাণ হারিয়েছে। আর বছর শেষে সে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৬ জনে।ইতালির 'পলিটিকামেন্ট কোরেটো' পত্রিকার ২২ জুলাই, ২০২৩ প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধে এই তথ্য জানানো হয়েছে
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে নিহতদের অধিকাংশই পুলিশের বাধা, বৈদ্যুতি শক, গুলি ও মারধরের কারণে প্রাণ হারিয়েছে বলে উঠে এসেছে। ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্সের দেওয়া তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে পুলিশের হাতে ২০২১ সালের চেয়ে অন্তত ৩১ জন বেশি প্রাণ হারিয়েছে। ২০২১ সালে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছিল ১ হাজার ১৪৫ জন। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৭৬ জনে।
তার আগে, ২০২০ সালে পুলিশের হাতে প্রাণ হারিয়েছিল ১ হাজার ১৫২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৯৭ জন, ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৪০ জন এবং ২০১৭ সালে প্রাণ হারিয়েছে ১ হাজার ৮৯ জন। সুতরাং বিগত পাঁচ বছরের ইতিহাসে ২০২২ সালেই সর্বোচ্চ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে পুলিশের হাতে।
২০১৩ সালের পর থেকে দেওয়া প্রতিবছরের হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে অন্তত ১১ হাজার ৬৮৪ জন।
দেশটিতে বিচারবহির্ভূতভাবে পুলিশের হাতে এত মৃত্যু হলেও কখনও প্রশ্ন তোলেনি দেশটি। এমনকি একবার কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েড হত্যার পর ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে জড়িত কর্মকর্তার বিচার হলেও অন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচারের কোনো কথা কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। অথচ সেই যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশের এলিট বাহিনী র্যাবের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে।
এত হত্যার পেছনে ‘রুটিন এনকাউন্টার’
যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রতিদিন পুলিশের হাতে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, এটি করা হয় ‘রুটিন এনকাউন্টার’ হিসেবে বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দেশটিতে ২০২২ সালে পুলিশের হাতে নিহত মোট সংখ্যার ১৩২ জনকে কোনো কারণ ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স।
এ ছাড়া ১০৪ জনের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, ৯৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে স্রেফ ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার ২০৭ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতার অভিযোগ ছিল না। নিহতদের মধ্যে ১২৮ জনের ক্ষেত্রে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কারণে ঝুঁকিতে পড়েছিল। ৩৭০ জনের বিরুদ্ধে এর চেয়েও ভয়াবহ অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। অন্য ১২৮ জন যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে পারিবারিক ঝামেলার অভিযোগ ছিল।
ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্সের প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল সিনিয়াংওয়ে বলেন, ’এগুলো নিয়মিত পুলিশের এনকাউন্টার হলেও এটি আসলে হত্যাকেই নির্দেশ করে।’
তিনি বলেন, ‘চারপাশে পুলিশের এই সহিংসতা কমানোর কথা হলেও এই সহিংসতা আসলে শেষ হচ্ছে না। এটা পরিষ্কার যে হত্যার ঘটনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সত্যি বলতে এটা গভীরভাবেই একটা সিস্টেমেটিক হত্যাকাণ্ড।’
৩২ শতাংশ পুলিশি হত্যার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিহত ব্যক্তিরা সাধারণভাবে দৌড়ে কিংবা গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। অবশ্য এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের দাবি, এসব ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ অযৌক্তিক, এগুলো জনসাধারণকে বিপন্ন করে তোলে।
গত বছরের জুনে ওহিও পুলিশ কর্মকর্তারা জেল্যান্ড ওয়াকার নামের এক ব্যক্তির ওপর কয়েক ডজন গুলি চালায়। ওয়াকার নিরস্ত্র ছিলেন এবং তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তার এক মাস পরই ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি গাড়ি থেকে বের হয়ে রবার্ট অ্যাডামস নামের এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে গুলি করে হত্যা করেন। সেখানেও দেখা গেছে, নিরস্ত্র অ্যাডামস বিপরীতে পালানোর চেষ্টা করছিলেন।
ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স তাদের তথ্য জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৩ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি হত্যার শিকার হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গরা। দেশটিতে মোট হত্যার ২৪ শতাংশই শিকার কৃষ্ণাঙ্গরা। অথচ তারা দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ।
দেশটির কেনোশা পুলিশের গুলিতে ২০২০ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়া এক যুবকের বাবা জ্যাকব ব্লেক সিনিয়র বলেন, ‘বিচারক, জুরি কিংবা জল্লাদের মতো পুলিশের ক্ষমতাকে অন্য স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা যতই জোর দিই না কেন এটা ভুল, তারপরও সমাজ এটা ঘটতে দিচ্ছে।’
অর্থসংবাদ/এসএম