গরু পাচারে সহায়তা করে বিএসএফ ও ভারতের কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তারা রোজগার করে কোটি কোটি টাকা। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে গবাদি পশু পাচারের তদন্তে নেমে এমনটাই জানতে পেরেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। পাচারের এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বিএসএফ, কাস্টমস-সহ ভারতের বিভিন্ন দফতরের একাধিক সরকারি কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে এ রাজ্যে গরু পাচার নিয়ে এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই।
বিএসএফের কমান্ডান্ট পদমর্যাদার কর্মকর্তা সতীশ কুমারকে এ চক্রের মূল অভিযুক্তদের অন্যতম প্রধান অভিহিত করে একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। ২০১৫-র ডিসেম্বর থেকে ২০১৭-র এপ্রিল পর্যন্ত সতীশ কুমার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিএসএফের ৩৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের কমান্ডান্ট ছিলেন।
সতীশ কুমার কমান্ডান্ট থাকাকালে ১৬ মাসে তার বাহিনী মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ জেলায় বাংলাদেশ সীমান্তে বাজেয়াপ্ত করেছিল প্রায় ২০ হাজার গরু। কিন্তু বাজেয়াপ্ত করা সেই গরুকেই বিএসএফের সরকারি নথিতে করা হচ্ছিল বাছুর। এর পর কম দামে সেই ‘বাছুর’ নিলাম হত স্থানীয় বাজারে। আর নিলামে সেই গরু ফের কম দামে কিনে নিত মুর্শিদাবাদের পাচারকারীরা। এরপর ওই গরুই সীমান্ত পেরিয়ে পাচার হয়ে যেত বাংলাদেশে। এতে বিএসএফ পেত গরু প্রতি ২ হাজার টাকা। আর ৫০০ টাকা কাস্টমস পেত।
মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) সিবিআইয়ের কলকাতার ডিআইজি অখিলেশ কুমার সিংহ একটি এফআইআর (আরসি ১০২০২০এ০০১৯) দায়ের করেন। সিবিআইয়ের করা ওই এফআইআরে অভিযুক্ত করা হয়েছে এই সতীশ কুমারকে। সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখার করা ওই এফআইআরে সতীশ একা নন, তার ছেলে, গরু পাচার চক্রের মাথা বিশু শেখ ওরফে মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী এনামুল হক, তার সঙ্গী আনারুল শেখ ও গোলাম মোস্তাফাসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের একাধিক সরকারি কর্মী এবং অন্যদের নাম রয়েছে।
গরু পাচারচক্রের সন্ধানে বুধবার কলকাতা, সল্টলেক, রাজারহাট, মালদহ, মুর্শিদাবাদ এবং ভিন্ রাজ্যে সব মিলিয়ে ১৩টি জায়গায় তল্লাশি করে সিবিআই। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অমৃতসর, গাজিয়াবাদ এবং রায়পুরে তল্লাশি চালান সিবিআইয়ের কর্মকর্তারা। সতীশের সল্টলেকের বাড়িতে তল্লাশি চলে। পরে এ দিন সন্ধ্যায় ওই বাড়ি সিল করে দিয়েছে সিবিআই। সতীশ বর্তমানে ছত্তীসগড়ের রায়পুরে কর্মরত। সেখানেও তল্লাশি চালান গোয়েন্দারা। সিবিআই হানা দেয় তার গাজিয়াবাদের বাড়িতেও। এ ছাড়া, মুর্শিদাবাদের কুলগাছিয়াতে অভিযুক্ত এনামুলের গ্রামে তার সিন্ডিকেটের দুই শাগরেদ গোলাম মোস্তাফা এবং আনারুল শেখের বাড়িতেও তল্লাশি চালান গোয়েন্দারা।
বিএসএফের অন্য এক কমান্ডান্ট জিবু ডি ম্যাথিউ ২০১৮ সালে বিপুল অঙ্কের হিসাব বহির্ভূত টাকাপয়সা-সহ ধরা পড়েন। সেই তদন্তেই উঠে আসে, ওই বিপুল অঙ্কের টাকা তিনি ঘুষ হিসেবে পেয়েছিলেন গরু পাচারকারী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে। জিবুকে জেরা করেই সেই সময় গ্রেপ্তার করা হয় মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী এনামুল হককে। এনামুল ওই মামলায় পরে জামিন পান। কিন্তু জিবু এবং তার বয়ানে উঠে আসে সতীশ কুমারের নাম।
ঘুষের উৎস জানতে ২০১৮-তেই সতীশের বিরুদ্ধে একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করে সিবিআই। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিএসএফের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে হাজার হাজার গরু পাচার করেছে বিশুর সিন্ডিকেট। মোটা টাকার বিনিময়ে সীমান্ত খুলে দেওয়া হয় গরু পাচার করতে।
বিএসএফের হাতে প্রায় ২০ হাজার গরু ধরা পড়লেও একবারও কোনো গাড়ি বা কোনো পাচারকারী ধরা পড়েনি। সিবিআই তদন্তকারীরা বলছেন, গাড়ি বাজেয়াপ্ত করলে সেই গাড়ির মালিক কে, কোথা থেকে গরু বোঝাই করা হয়েছে- এ ধরনের প্রশ্ন ওঠে। পাচারকারীদের সঙ্গে আঁতাতের জন্যই সেই সূত্র কোথাও রেখে দেননি তারা।
বিএসএফ এবং কাস্টমসের পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরও নাম উঠে এসেছে প্রাথমিক অনুসন্ধানে। ওই প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও বিএসএফ এবং কাস্টমসের কর্মকর্তাদের মতোই লাভবান হয়েছেন গরু পাচারের সিন্ডিকেট থেকে।