ঋণ দেয়ার এ উদ্যোগে সরকারি খাতের রূপালী ব্যাংক এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে প্রথমে সম্মত হলেও পরে তারা আবার ওই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
এখন সরকারি খাতের অগ্রণী ব্যাংককে এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে।
ব্যাংকটি এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়ার এমন উদ্যোগের ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে-বাইরে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এটি কোনো ক্রমেই উচিত হবে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার যে সংস্কৃতি দেশে গড়ে উঠেছে, সে কারণে খেলাপি ঋণ হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে।
বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় যেসব সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিট নেয়া হচ্ছে সেগুলোও খেলাপি হয়ে পড়ছে। গ্রাহকদের পাশাপাশি যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক নিজেরাই খেলাপি হয়ে পড়ছে।
রিজার্ভের ঋণ ফেরত না এলে দেশের দুর্নাম আরও ভয়ানক হবে। করোনার কারণে এখন ব্যবসায়িক অবস্থায় মন্দা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়াটা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
তারা আরও বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া ও পাচার করার অনেক নজির রয়েছে। শেয়ারবাজার থেকেও টাকা সরানো হয়েছে।এখন আবার রিজার্ভের দিকে নজর পড়েছে।
রিজার্ভ হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের শেষ ভরসা। কোনো কারণে এখান থেকে দেয়া ঋণের অর্থ ফেরত না এলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা। দেশে এর আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কোনো ঋণ দেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। বিষয়টি একেবারেই নতুন। এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেয়ার আগে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে এর ঝুঁকি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বিশদ পর্যালোচনার প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু সে ধরনের কোনো আলোচনা হয়নি। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ পর্যায়েও ভালোভাবে অবহিত করা হয়নি। এমনকি পর্ষদেও এ বিষয়ে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে নেই কোনো নীতিমালাও।
কোনো রকম আলোচনা, নীতিমালা বা সিদ্ধান্ত ছাড়াই এ ধরনের প্রস্তাব বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসার পর অনেকেই অবাক হয়েছেন। কী করবেন অনেকেই কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না।
কিন্তু রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়ার বিষয়টি এগিয়ে যাচ্ছিল। এ বিষয়ে তথ্য প্রদান ও চিঠি চালাচালি হচ্ছিল। কিন্তু মাঝপথে বেঁকে বসেছে রূপালী ব্যাংক। তারা প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের পর্ষদ সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োজিত পর্যবেক্ষক তীব্র আপত্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, এ ধরনের নতুন একটি বিষয় পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা ব্যাংকের নেই।
কেননা, কোনো কারণে গ্রাহক ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে তা রূপালী ব্যাংকের হিসাব থেকে কেটে নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রক্রিয়ায় রিজার্ভ থেকে ঋণের এজেন্ট হলে ব্যাংক বিপদে পড়তে পারে।
এছাড়া প্রকল্পে বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। এমন যুক্তিতর্কের পর ব্যাংক নিজ থেকেই প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
এরপর উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এ ঋণের এজেন্ট হওয়ার জন্য অগ্রণী ব্যাংককে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংকও এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা রিজার্ভ থেকে ঋণ সরাসরি কোনো গ্রাহককে দেয়া যায় না। কেননা গ্রাহকদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরাসরি কোনো লেনদেন নেই। এ জন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাহকদের মধ্যে ঋণ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এজন্যই রিজার্ভ থেকে ঋণ নিতে এজেন্ট নিয়োগের প্রয়োজন। সূত্র জানায়, রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়ার উদ্যোগটি বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে এখনও চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করা হয়নি। বিষয়টি এখনও আলোচনা এবং যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে।
এ বিষয়টি ব্যাংকিং খাতে সীমিত আকারে চাউর হওয়ার পর আরও কয়েকটি গ্রুপ রিজার্ভ থেকে ঋণ নেয়ার জন্য যোগাযোগ শুরু করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকে। ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে খোঁজখবর নিতে শুরু করে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তাদের এ ধরনের প্রস্তাব পাঠাতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ ধরনের উদ্যোগের আগে যারা এটি পরিচালনা করবেন তাদের প্রশিক্ষণ ও এর ধরন সম্পর্কে ধারণা দেয়া দরকার। রিজার্ভ হচ্ছে দেশের জনগণের সম্পদ।
সরকারের পক্ষে এটি পরিচালনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ থেকে ঋণ দেয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদের অনুমোদন দরকার। প্রণয়ন করা জরুরি একটি নীতিমালা।
অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়কে অবহিত করাটাও জরুরি। এসব আনুষ্ঠানিক ছাড়া কোনোক্রমেই রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়ার বিষয়টি ভাবা ঠিক হচ্ছে না। রিজার্ভ রাখা হয় দেশের জরুরি বা দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে ব্যবহারের জন্য।
এখন দেশে স্বাভাবিক অবস্থা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়। রিজার্ভ থেকে দেয়া ঋণের অর্থ কোনো কারণে ফেরত না এলে দেশের ভাবমূর্তি যেমন চরমভাবে ক্ষুণ্ন হবে, তেমনি দেশ মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।