গতকাল ৩৭তম আসিয়ান সম্মেলনের সমাপনী দিনে রিজিয়নাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) শীর্ষক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন আসিয়ানভুক্ত দশটি দেশ ও তাদের এফটিএ অংশীদার পাঁচটি দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। চুক্তিবদ্ধ হওয়া ১৫টি দেশ হলো আসিয়ানভুক্ত ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এবং তাদের এফটিএ অংশীদার অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন।
চুক্তিটি স্বাক্ষর হলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। সিঙ্গাপুরের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী চ্যান চুন সিং জানান, আরসিইপি কার্যকর হতে অন্তত ছয়টি আসিয়ান দেশ ও তিনটি আসিয়ান-বহির্ভূত অংশীদার দেশের অনুমোদন পেতে হবে। সিঙ্গাপুর আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ চুক্তিতে অনুমোদন দেয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জানান তিনি।
এদিকে এবারের আসিয়ান সম্মেলনের আয়োজক দেশ ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী নুয়েন হওয়ান ফুক বলেছেন, চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলো শিগগিরই আরসিইপি কার্যকরের অনুমোদন দেবে এবং কভিড-১৯ মহামারী-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অবদান রাখবে বলে তিনি আশা করছেন।
আরসিইপিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এফটিএ বলা হচ্ছে, কারণ বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী ও এক-তৃতীয়াংশ জিডিপি এ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আসবে। চুক্তিবদ্ধ ১৫টি দেশে প্রায় ২২০ কোটি মানুষের বসবাস। অর্থাৎ বাজারটি বেশ বড়। আর বৈশ্বিক জিডিপিতে অঞ্চলটির সম্মিলিত অবদান ৩০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে এ ১৫টি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার।
আরসিইপি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এ চুক্তির ফলে আশিয়ানভুক্ত ১০টি দেশের পাশাপাশি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো বাণিজ্যিক পরাশক্তির সঙ্গে সরাসরি অংশীদারিত্বে যাচ্ছে চীন। আর বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চলে বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বে এগিয়ে থাকার অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আবার পুরোটাই ভিন্ন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের (টিপিপি) উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগ কার্যকর হলে প্রশান্ত মাহাসাগরীয় অঞ্চলে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক বলয় তৈরি হতো। কিন্তু ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে টিপিপি চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন।
আরসিইপি কতটা প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা একটি উদাহরণের মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এশিয়ার দুই শীর্ষ অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন ও জাপান এই প্রথম কোনো চুক্তিতে যুক্ত হলো, যার মাধ্যমে দেশ দুটির মধ্যকার বাণিজ্যে শুল্ক বাধা অনেকটাই দূর হবে। এর মাধ্যমে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত জাপানের বাজারেও প্রবেশের পথ তৈরি করল চীন।
২০১২ সালে কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনে আরসিইপির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে শুল্ক কমানো, সরবরাহ শৃঙ্খল শক্তিশালী করা ও ই-কমার্সের জন্য নতুন বিধিবিধান চালু করা।
আরসিইপির ফলে মার্কিন ও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাইরের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সেখানে ব্যবসা করতে গিয়ে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে পারে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের টিপিপি আলোচনা থেকে সরে যাওয়া ও আরসিইপি চুক্তি বাস্তবায়নের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলোর এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করাটা কঠিন হয়ে পড়বে। আর বিশ্লেষকরা তো বলেই দিয়েছেন, আরসিইপি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চুক্তি হলেও এর প্রভাব কেবল অঞ্চলটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সূত্র রয়টার্স, ব্লুমবার্গ।
অর্থসংবাদ/ এমএস