তবে নাগরিকদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো এই অর্জনের সত্যাসত্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। দ্য ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিউন অঞ্চল সর্বশেষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। কিন্তু সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে যে জরিপ চালিয়েছে, তাকে দায়সারা বলে আখ্যা দিয়েছেন জিউনের এক গ্রামবাসী। ইকোনমিস্টকে তিনি জানান, সরকারি লোকজন তাঁদের গ্রামে এসে তাড়াহুড়া করে ঘোষণা দিয়ে যায়, এই গ্রাম এখন থেকে চরম দারিদ্র্যমুক্ত।
তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যক্তিমানুষের কিছু ক্ষোভ-বিক্ষোভ সত্ত্বেও পর্যবেক্ষকেরা চীন সরকারের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করবেন। জিউনের সেই গ্রামবাসীর জন্য জীবন কিছুটা কষ্টকর হয়েছে, তা ঠিক। শূকরের মাংসের দাম বেড়েছে। তাতে সপ্তাহে দু-এক দিনের বেশি মাংস খাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ দেওয়ার পর তাঁর কাছে খুব সামান্যই কিছু অবশিষ্ট থাকে তাঁর কাছে। এটা ঠিক, চীনের নগরবাসীদের তুলনায় তিনি অনেক গরিব, কিন্তু এই যে পরিবার-পরিজন নিয়ে যে খেয়ে-পরে থাকতে পারছেন তিনি, তাতেই পরিষ্কার, চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। অর্থাৎ মৌলিক চাহিদা তিনি এখন একভাবে মেটাতে পারছেন। তবে বাবার ফুসফুস ক্যানসারের যথাযথ চিকিৎসা করানোর মতো যথেষ্ট টাকা তাঁর নেই।
অনেকেই ভাবতে পারেন, চীন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে পরিসংখ্যান নিয়ে কারসাজি করেছে। জায়গায় জায়গায় এখনো বঞ্চনা থাকলেও দারিদ্র্যের সীমারেখা চীন বেশ কয়েকবার বাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুসারে দিনে ১ দশমিক ৯০ ডলার রোজগার থাকলেই বলা যায়, সেই ব্যক্তি চরম দরিদ্র নন। কিন্তু চীন সেই সীমারেখা নির্ধারণ করেছে দিনে ২ দশমিক ৩০ ডলার—২০১১ সালের দ্রব্যমূল্য হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেটা আরও অনেক বেশি—২০২০ সালের দ্রব্যমূল্যের হিসাবে চারজনের পরিবারের দৈনিক ৭২ ডলার। বাস্তবতা হলো, মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পর ১৯৭৮ সালে আজকের এই মানদণ্ডে চীনের গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ চরম দরিদ্র ছিল।
কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা থেকে সরে গিয়ে মানুষকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ দেওয়ার জন্য এই চরম দারিদ্র্যমুক্তি সম্ভব হয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। বিশেষ করে ১৯৮৯ সালে তিয়েন আন মেন স্কয়ারের সেই বিক্ষোভের পর চীন সরকার নাগরিকদের জন্য অর্থনীতি আরও খুলে দেয়। চীনা লেখক মিন ঝিন পির মতে, এটাই ছিল পরিবর্তনের ভিত্তি। কৃষি থেকে সমবায় প্রথা তুলে নেওয়া এবং কৃষকদের অধিক উৎপাদনে প্রণোদনা দেওয়া—এসব কারণেও দারিদ্র্যমুক্তি ত্বরান্বিত হয়েছে। উদ্যোক্তাদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। আর সরকার অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে যা যা করা দরকার, সব করেছে। তবে সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগানো, দারিদ্র্যমুক্তি ছিল বাড়তি পাওনার মতো।
এরপর সি চিন পিং সরকার ২০১৫ সালে এই ধারায় পরিবর্তন আনে। ২০২০ সালের মধ্যে দেশ থেকে চরম দারিদ্র্যের শেষ নিদর্শন দূর করার লক্ষ্য ঘোষণা করা হলে সরকারি কর্মকর্তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। গরিব মানুষ অবস্থার উন্নতি করতে বিশেষ উদ্যোগ নিলে যেমন উৎসাহিত করা হয়েছে, তেমনি দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারি বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে। এই লক্ষ্যে সরকার ২০১৫ সালে চরম দরিদ্র ব্যক্তিপ্রতি ৫০০ ইউয়ান বরাদ্দ দেয়, ২০২০ সালে যা ২ হাজার ৬০০ ইউয়ানে উন্নীত করা হয়। এর ফলও পাওয়া গেছে, ২০১৫ সালে চরম দারিদ্র্য বিমোচনে যখন ৪০ বিলিয়ন ইউয়ানের মতো বরাদ্দ দেওয়া হয়, তখন চরম দারিদ্র্য ছিল ৫ শতাংশের মতো। আর এই পাঁচ বছরে বরাদ্দ যত বাড়ানো হয়েছে, চরম দারিদ্র্যও তত কমেছে।