জানা গেছে, মান্দালয় শহরে বিক্ষোভে ‘চীনা কোম্পানি বেরিয়ে যাও’, ‘চীনা গ্যাস পাইপলাইনে আগুন জ্বলবে’ - এমন স্লোগানও উঠেছে। মিয়ানমার-চীন গ্যাস পাইপলাইনটি গেছে মান্দালয়ের পাশ দিয়েই।
‘শেম অন ইউ চীন। দেশ লুটপাটে সমর্থন বন্ধ কর’- চীনা দূতাবাসের কাছে সম্প্রতি এক বিক্ষোভে এমন পোস্টার দেখা গেছে।
পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে চীন নিয়ে বহু গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো কোনো পোস্টে মানুষ এমন কথাও লিখেছে যে, তারা নিজের চোখে রাস্তায় চীনা সৈন্যদের দেখেছে। চীনা নববর্ষ উপলক্ষে মিয়ানমার থেকে মাছ নিয়ে অনেক ফ্লাইট চীনে গেছে। এমন সন্দেহও প্রকাশ করা হয়েছে যে, চীন থেকে বিমানে করে সৈন্যদের আনা হচ্ছে।
সামািজিক মাধ্যমে এমন কথাও লেখা হয়েছে যে, ইন্টারনেটে ফায়ারওয়াল তৈরি করতে চীনা ইঞ্জিনিয়ার আনা হয়েছে। তবে মিয়ানমারে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত রয়টার্সের কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথাকে ‘আবোল-তাবোল’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
এরপর রোববার প্রথমবারের মতো চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে সরাসরি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইয়াঙ্গুনের শহরতলীতে একটি শিল্প এলাকায় ৩২ চীনা মালিকানাধীন কারখানায় হামলা করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি মিডিয়ায় বলা হয়েছে আগুন নেভানোর জন্য দমকল বাহিনীর গাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করলে হাজারখানেক বিক্ষোভকারী রাস্তা আটকে দেয়।
এই ঘটনার পর চীন সরকারের পক্ষ থেকে চীনা ব্যবসা এবং সেখানে কর্মরত তাদের নাগরিকদের রক্ষার জন্য মিয়ানমার সরকারের কাছে আহ্বান জানানো হয়।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান সোমবার বলেন, ‘আমারা আশা করি চীনা কোম্পানির সম্পদ এবং চীনা নাগরিকদের জীবন রক্ষায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’
চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমস তাদের এক সম্পাদকীয়তে মিয়ানমারে ‘উস্কানিদাতাদের’ শাস্তি দাবি করা হয়েছে।
কারখানায় অগ্নিকান্ড এবং চীনের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়ার পরপরই মিয়ানমারের সামরিক সরকার ইয়াঙ্গুন এবং মান্দালয় ছাড়াও আরো কিছু শহরে সামরিক আইন জারি করেছে। এসব জায়গায় বিক্ষোভকারীদের এখন সামরিক আদালতে বিচার করা যাবে।
কে বা কারা চীনা কারখানায় আগুন দিয়েছে তা এখনও পরিষ্কার নয় । কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে মিয়ানমারের এক সাংবাদিক বিবিসিকে বলেন, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের সরাসরি নিন্দা না করার জন্য অং সান সুচির বহু সমর্থক চীনের প্রতি ক্ষুব্ধ।
বিশেষ করে ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের সপ্তাহ দুয়েক আগে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক সফর নিয়ে বহু মানুষের মনে এই সন্দেহ ঢুকেছে যে চীন সব জানতো এবং তাদের গ্রিন সিগন্যালেই এই অভ্যুত্থান করার সাহস পেয়েছে সেনাবাহিনী।
চীনবিরোধী এই প্রচারণা, চীনা কারখানায় অগ্নিকান্ড বা গ্যাস পাইপলাইনে আগুন দেওয়া নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে এই হুমকি চীনের জন্য কতটা উদ্বেগের? চীনের জন্য খুবই উদ্বেগের বলে মনে করেন কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব চায়নার অধ্যাপক ড সৈয়দ মাহমুদ আলী।
তিনি বলেন, কৌশলগত অর্থনীতির স্বার্থে যে দুটো দেশ চীনের কাছে এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ তার একটি হলো পাকিস্তান, অন্যটি মিয়ানমার।
তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে যে জলপথ দিয়ে পারস্য উপসাগর থেকে চীনের জ্বালানি সরবরাহ আসে-ভবিষ্যতে সেই মলাক্কা প্রণালীর নিরাপত্তা নিয়ে চীন অনেকদিন ধরেই চিন্তিত। সুতরাং ঐ জলপথের বিকল্প হিসেবে তারা পাকিস্তান এবং মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে ভারত মহাসাগরে যাওয়ার সুবিধা তৈরি করেছে।’
মিয়ানমারের বঙ্গোপসাগরে চীনা বিনিয়োগে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে একটি তেলের পাইপলাইন চীনের ইউনান প্রদেশে গেছে যেটি ২০১৭ সালে চালু হয়। গ্যাসের আরেকটি পাইপলাইন ২০১৩ সালে চালু হয় যা দিয়ে মিয়ানমারের সমুদ্রে উৎপাদিত গ্যাস চীনে যাচ্ছে। এই দুই প্রকল্পে চীন মিয়ানমারে কম-বেশি ৩ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
তাছাড়া, মিয়ানমার চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোরের (সিএমএফসি) বিভিন্ন অবকাঠামোর জন্য নতুন ৯শ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। নতুন আরেকটি বন্দর এবং চীন সীমান্ত পর্যন্ত একটি রেললাইন নির্মাণ এসব পরিকল্পনায় রয়েছে।
মিয়ানমারে ক্রদ্ধ জনমত চীনের এসব পরিকল্পনায় ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করেন ওয়াশিংটনভিত্তিক স্টিমসন সেন্টারের পরিচালক ইয়ুন সান। তিনি বলেন, মিটসোন বাঁধ প্রকল্প নিয়ে অতীতে চীনের সুনাম অনেক ক্ষুণ্ণ হয়েছে যার পরিণতিতে ২০১১ সালে প্রকল্পটি বাতিল হয়।
তারপর থেকেই চীন মিয়ানমারে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভাবমূর্তি উন্নয়নে তৎপর হয়। রাজনীতিকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের সাথেও যোগাযোগ বাড়ায়। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানে সেই চেষ্টা অনেকটা হুমকিতে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
ড. মাহমুদ আলী বলেন, চীনা পররাষ্ট্রনীতির প্রধান একটি মূলমন্ত্র হচ্ছে, তারা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবে না এবং মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও তারা গত তিন দশক ধরে সেই নীতিই অনুসরণ করছে।
মিয়ানমারে যেই ক্ষমতায় আসুক তাদের সাথে বেইজিং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখছে। সেনা শাসন শেষে যখন অং সান সুচি ক্ষমতায় এলেন তখনও তার সরকারের সাথেও সমানভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে চীন। তেমনি ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থানের পরও চীন সরাসরি তার নিন্দা করেনি।
তবে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান বিরোধী জনরোষ যে মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা এবং সেখানে দীর্ঘমেয়াদী চীনা স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করতে পারে, তা হয়ত চীন সরকার বুঝতে পারছে।
সে কারণেই সম্ভবত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ই গত ৭ মার্চ বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্কট নিয়ে দেশের সব পক্ষের সাথে কথা বলবে চীন। ইয়াং ই বলেন, ‘মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব এবং সেখানকার মানুষের ইচ্ছার কথা মাথায় নিয়ে চীন সব পক্ষের সাথে কথা বলতে এবং উত্তেজনা হ্রাসে ভূমিকা পালনে প্রস্তুত।’
কিন্তু মিয়ানমারে আপোষ মীমাংসায় কার্যকরী কোনো ভূমিকা রাখার সক্ষমতা কতটা রয়েছে চীনের? ড. আলী মনে করেন, যদি সেটা কেউ পারে সেটা চীনই পারবে। কারণ শুধু সেনাবাহিনী নয়, মিয়ানমারের সব দলের সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে চীনের।
এনএলডির সাথেও তাদের সম্পর্ক খুবই ভালো। অং সান সু চি কয়েকবার বেইজিং গেছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যখন পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে চাপে পড়েছিলেন সু চি তখনও বেইজিংই তাকে সমর্থন জুগিয়েছে।