কিছু মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে অনেকটা মিরাকেলের মতো। যেমন জ্যাকি একটি খুব দামি কাপড়ের ব্রান্ড নেম। জ্যাকি ছিলেন আমেরিকার এক ফটো মডেল পরে তিনি বিয়ে করেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জে এফ কেনেডিকে। জ্যাকি হয়ে গেলেন বিশ্ব পরিচিত আমেরিকার ফার্স্ট লেডি, পরে তার নামে নামকরণ করা হলো জ্যাকি ব্রান্ড। এরকম হাজারও নাম রয়েছে যাদের সামান্য একটি কথায় পৃথিবীর অর্থনীতি তছনছ হয়ে যেতে পারে।
যেমন কয়েকদিন আগে ফুটবল খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো প্রেস কনফারেন্সের টেবিল থেকে কোকাকোলার দুটো বোতল সরিয়ে পানি টেনে নিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে বিশাল অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলে কোকাকোলা কোম্পানির উপর। রোনালদোর এমন কাণ্ডের পর কোকাকোলার বোতলের পাশাপাশি সেভেন আপের বোতল সরিয়ে রাখার অনুরোধ করছে অনেকে। এই ঘটনার পর পরিষ্কার বোঝা গেল একজন ব্যক্তির ক্ষমতা কতো হতে পারে।
একবার আমার কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফ্রেড হাসান শেয়ার বাজারের একটি কনফারেন্সে কিছু বলতে হঠাৎ হ্যাঁচি দেন, সঙ্গে সঙ্গে ফাইজার স্টক ফল করে, (ফ্রেড আমেরিকা থেকে সরা সরি ফ্লাই করে সুইডেনে এসেছেন, হঠাৎ প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে তাঁর সর্দি কাশি হয়, যার ফলে তিনি কিছুটা অসুস্থ হন, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হঠাৎ হ্যাঁচি দেন)। ক্ষমতা কাকে বলে বা নামের মূল্য কতো! আবার অনেক নাম রয়েছে যারা সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে, তা সত্ত্বেও তাদের মানুষ বলে গণ্য করতে অনেকে অস্বীকার করে এমন নজিরও রয়েছে। ব্যক্তির ক্ষমতা নির্ভর করে তার কর্মের উপর।
এখন সব সময় উচ্চ শিক্ষার কারণে ক্ষমতা পাওয়া সম্তব তাও সঠিক নয়। তবে অঢেল শিক্ষা থাকলে সমাজের বড় বড় পোস্টগুলো দখল করা সম্ভব। বড় বড় পোস্টে কাজ করা মানে অনেক দায়িত্ব, অনেক সুযোগ সুবিধা। এসব দায়িত্ববান ব্যক্তির পক্ষে ভালো মন্দ সবই করা সম্ভব।
ভালো কাজে খ্যাতি মন্দ কাজে বদনাম এটাই স্বাভাবিক। আমাদের ধারণা শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড, এমনটি ধারণা নিয়ে সমাজে বসবাস করছি। কিন্তু শিক্ষা জাতির মেরুদন্ডকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে বা ফেলে সেটা কখনও ভেবে দেখিনি। সমাজের সব ধরণের গুরুদায়িত্বে যারা আছে তাদের বেশিরভাগই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের ব্রান্ড নেম রয়েছে যেমন ধরুণ অর্থমন্ত্রী বা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইত্যাদি। এদের শিক্ষার অভাব নেই, অথচ যদি কর্মের ফলাফল দুর্নীতিযুক্ত হয় তাহলে কী দাঁড়ালো বিষয়টি? আবার ধরুণ সমাজে অতি সামান্য শিক্ষায় শিক্ষিত বা পুঁথিগত বিদ্যা নেই বললেই চলে এমন লোক রয়েছে, যার তেমন খ্যাতি নেই, হতে পারে মুচি বা মেথর অথচ সমাজের ছোট কাজটি সঠিকভাবে পালন করে সমাজকে দূষণমুক্ত এবং সুন্দর পরিবেশ দিচ্ছে। তাহলে শিক্ষা হচ্ছে জেনে শুনে বিষ পান করার মতো। সেক্ষেত্রে শিক্ষিত লোকের নৈতিকতার অধঃপতনের পেছনে তার শিক্ষা দায়ী।
আমার কাছে কী কাজ সেটা বড় কথা নয়, কিভাবে কাজকে বিবেচনা করা হয়, কিভাবে কর্মীদের ট্রিট করা হয়, কী তাদের ঝুকিপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা, অসুস্থ হলে কে তাদের দায়ভার নিবে, রিটায়ারমেন্টে গেলে কী হবে, সমাজের চোখে তাদের মর্যাদা কোথায় এসব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
নিজেকে ব্রান্ড নামে প্রভাবিত করে কী লাভ যদি সমাজকে নোংরায় ভরে রাখা হয়। সমাজে যে নোংরা পরিবেশ প্রতিদিন তৈরি করা হয়, কে পরিষ্কার করে? যদি বলি সুইপার সমাজের একটি বড় ব্রান্ড নেম, সবাই হঠাৎ চমকে উঠবে, এমনকি রেগে আমাকে গালিগালাজ করবে। পরে বলবে আমার মাথায় সমস্যা আছে ইত্যাদি। ভাবুন নিজের পেট ভরা বর্জ অথচ সমস্যা নেই। পেট থেকে বর্জ বের হবার পর নিজের বর্জ্যের পাশে কেউ থাকতে চাইবে না, কারণ যে দুর্গন্ধ হঠাৎ নাকে ঢুকবে সেটা সহ্য করা কঠিন। ঠিক তেমনি সমাজের বড় বড় দায়িত্বে থাকা কর্মীর ফলাফল যখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তখন সমাজ তাকে ঘৃণা করে ঠিক বর্জ্যের মতো। তাহলে কী লাভ হলো নিজেকে নামি দামি বলে দাবি করে, যদি সমাজের এই মহৎ ব্যক্তিগণ সারাক্ষণ ডাস্টবিনে পড়ে থাকে তাদের ধানে এবং জ্ঞানে? যদি মনের ময়লা আবর্জনাগুলো পরিষ্কার না করে, তাহলে কী হবে ব্রান্ড নেম দিয়ে?
বাংলাদেশ হয়তো মনে করে তারা বিশ্বের উন্নত দেশে ধাবিত হতে চলেছে। কোন কোন দিক বিবেচনা করলে হয়তোবা কিছুটা সত্য। কিন্তু সত্যিকারভাবে গর্বিত জাতি হিসেবে নিজেদের দাবি করার আগে আসুন জেনে নেই কিছু অপ্রিয় সত্য তথ্য। উপরের ছবিটি একজন মেথর, ঝাড়ুদার বা ডাস্টমানের। ছবিই কথা বলে।
কী ঝুঁকিপূর্ণ জীবন তার, দেখুন কী তার নিরাপত্তা, কী পুঁথিগত শিক্ষা রয়েছে তার? কী পরিমাণ অর্থ সে মাসে রোজগার করে? সমাজের চোখে তাকে কিভাবে দেখা হয় ইত্যাদি। ঢাকায় সুয়ারেজ লাইন পরিস্কারের কাজ করছেন ১৫ বছর ধরে, তিনি মাসে আয় করেন ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজ করে তিনি প্রায়ই আহত হন, জ্বরসহ শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছেন তিনি প্রতিনিয়ত। নেই ভালো বাসস্থান, নেই ভালো শিক্ষা, নেই ভালো চিকিৎসা তবুও তিনি সমাজের নোংরা পরিষ্কার করে চলছেন।
একই সাথে আসুন জেনে নেই ঠিক একই কাজের অন্য আরেক দেশ যেমন সুইডেনের মেথর, ঝাড়ুদার বা ডাস্টম্যান যাই বলি না কেন তার জীবনব্যবস্থা। সুইডিশ ভাষায় আমরা বলি প্রত্যয়িত আবর্জনা সংগ্রহকারী, প্রত্যয়িত আবর্জনা সংগ্রাহক এমন একটি কাজ যা প্রতিদিন করতে হয়। বর্জ্য সংগ্রহকারী হিসেবে একটি মেয়ে সমাজের বর্জ্য ট্র্যাকে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে চলছে। কাজের পরিবেশ, গুণমান, পরিষেবা, গ্রাহক পরিষেবা এবং আরও অনেক কিছু সম্পর্কে তার জ্ঞান রয়েছে। ভাল জ্ঞানের সাথে, কাজটি আরও দক্ষ এবং আরও আনন্দের সঙ্গে করছে। এরা নবম শ্রেণি শেষ করার পর এর উপর প্রশিক্ষণ শেষে এ কাজ করে। নিজের গতিতে প্রশিক্ষণ পুনরায় শুরু করতে পারে এবং যে কোনও সময় বাতিল করতে পারে। কোর্সটি শেষ করার পরে, একটি ডিপ্লোমা মুদ্রণ করতে পারে। এদের পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে, সেফটি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বেতন, ছুটি, ভাতা সহ সকল রকমের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এখানে সুইডেনের একজন মেথর, ঝাড়ুদার বা ডাস্টমান যাই বলি না কেন ছবিই কথা বলে।
ছবি নিজেই তার প্রমাণ। একই কাজ দুটি ভিন্ন দেশে রয়েছে, কর্মের ধরণ এবং বেতনে বিশাল পার্থক্য। ভাবতেই গা শিউরে উঠে! একই সাথে সুইডেনের একজন অর্থ বা স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অর্থ বা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দিকটা দেখুন বলতে গেলে সম্পুর্ণ উল্টো। কারণ কী? কারণ দরিদ্র দেশের সাধারণ মানুষ নির্যাতিত, নিপীড়িত, বিতাড়িত সেই দেশেরই খ্যাতনামা শিক্ষাধারীদের দারা। সবাইকে সুন্দর নাগরিকের অধিকার দিতে হবে। সেটা কি সম্ভব হয়েছে আজও? তাহলে কি দরকার আছে এ শিক্ষার? যদি শিক্ষা শুধু শ্রেণীর সৃষ্টি করে?
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে।