মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করা হয়েছে। শিক্ষা, কৌশলগত দক্ষতা ও নানাবিধ যোগ্যতার মাপকাঠিতে একজন অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। প্রতিটি মানুষের জন্যই মৌলিক প্রয়োজন পূরণের পর্যাপ্ত উপকরণ দিয়েই তাদেরকে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বন্টনগত অসামঞ্জস্যের কারণে সমাজের একটি অংশ চালচুলোহীন আর একটি অংশ সীমাহীন বিলাস ব্যসনে মগ্ন। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বড় ধরণের বিশৃংখলা। মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে অগনিত মানুষ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ধনীদের সংখ্যা। স্বাধীনতা পরবর্তী বিধ্বস্ত বাংলাদেশের দারিদ্রের হার ছিল ৭০ শতাংশের বেশি। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে দেশ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে দেশের মাথাপিছু গড় আয় ২৫৯১ ডলার যা প্রায় ২ লাখ ২২ হাজার টাকার সমপরিমাণ। সেই হিসেবে প্রত্যেকের মাসিক আয় সাড়ে ১৮ হাজার টাকারও বেশি। তবে সার্বিক অবস্থা তার ব্যতিক্রম। যার কারনে শহরের পার্ক ও ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে অনেক মানুষকে রাত যাপন করতে দেখা যায়।
দিনদিন মানুষের আয় বৈষম্য বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায় বাংলাদেশের ১ শতাংশ মানুষের আয় ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ আর মোট আয়ের ৪৪ শতাংশ রয়েছে ১৬ শতাংশ মানুষের হাতে। বিপরীতে নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষের আয় ১৭.১ শতাংশ। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে করপূর্ব জাতীয় আয়ের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল ১ শতাংশ মানুষের হাতে। বিপরীতে নিচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল সম্পদের ২০ শতাংশ।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের হিসেবে ব্যাংকে কোটি টাকার উপরে জমা ছিল মাত্র পাঁচ জনের। সেটি বর্তমানে এক লাখ ২৩৯ জনে দাঁড়িয়েছে। কোটিপতি সংখ্যার এই উল্লম্ফনকে ‘অর্থনৈতিক বৈষম্য’ বলে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। এর বিপরীতে দারিদ্রের হার আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।
দেশের দারিদ্র না কমার পেছনে বৈষম্যকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই বৈষম্য আয়ের পাশাপাশি জীবন ধারণের নানা বিষয়ে ক্ষেত্রেও। আয় বৈষম্য কমিয়ে দারিদ্র্য কমাতে সরকারের নানা পদক্ষেপ রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় সরকার দরিদ্র ভূমিহীন ও অসহায় মানুষের জন্য আবাসনসহ নানাবিধ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে থাকে। তবে বরাদ্দকৃত এসব অর্থ সঠিকভাবে পায় না দরিদ্ররা। সেই সহযোগিতার সিংভাগই থেকে যায় রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহারকারী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ, অবকাঠামো ও ব্যবসা বাণিজ্যসহ উন্নয়নের সকল পথে দুর্নীতিকে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এ সমস্যা দূরীকরণে জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সকল স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মানসিকতা লালন ও পরিপালন করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট(এসএইচআরএম)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় বিশ্বের বেশিরভাগ ভাল প্রতিষ্ঠান অন্যদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ন্যায্যতাভিত্তিক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করে থাকে। ব্যবসায়িক উন্নয়নে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে বেতন কাঠামো আকর্ষণীয় করা হয়।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা পাই। ইসলামী অর্থব্যবস্থা ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করার নির্দেশনা দেয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- যেন তোমাদের মধ্য থেকে শুধু বিত্তবানদের মাঝেই সম্পদ আবর্তিত না হতে থাকে। শরীআহ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেতন বা মজুরি নির্ধারণের নির্ধারিত কোন নির্দেশনা না থাকলেও প্রতিষ্ঠানের সামর্থের দিকে খেয়াল রেখে স্বাভাবিক জীবন যাত্রার প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা উচিত। মানুষের মধ্যে ইনসাফ ও ইহসান প্রতিষ্ঠা ইসলামের নির্দেশনা।
আয়ের এই বৈষম্য কমাতে ইসলাম যাকাতের বিধান দিয়েছে। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদশালীদের সম্পদ যেমন পরিশুদ্ধ হয় ঠিক তেমনই সম্পদহীন মানুষের হাতেও কিছু সম্পদ আসে। এতে দরিদ্রদের কষ্ট যেমন লাঘব হয় তেমনি বেড়ে যায় সামাজিক সম্প্রীতি। যাকাতের বাইরেও সাধ্যমত সাদাকা করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। দারিদ্র্য দূর করতে ওয়াকফ এবং সাদাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দেশের বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানই রাজধানী ও তার আশে পাশে গড়ে উঠেছে। দারিদ্র্য ও আয় বৈষম্য দূরীকরণে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সকল অঞ্চলে সুষম শ্রমঘন শিল্পায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে সকল মানুষের দোরগোড়ায় পৌছে দিতে হবে উন্নয়নের সুফল ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আয়ের বৈষম্য কমলেই মূল্যায়ন হবে কাজের। গৃহস্থালি থেকে শুরু করে সকল কাজে বাড়বে গতি। বন্ধ হবে মেধা ও অর্থ পাচার। কমবে বিদেশে বসবাসের প্রবণতা। অভূতপূব অগ্রগতি হবে শিল্প খাতে। যা উন্নত দেশের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে দেবে বাংলাদেশকে। কর্মক্ষেত্রে মজুরি বা সম্মানি দেয়ার বিষয়েও সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ের একটি ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। জীবনধারণের জন্য মৌলিক প্রয়োজন পূরণের প্রাসঙ্গিক ন্যূনতম ব্যয়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই বেতন নির্ধারণ করা জরুরী। অন্যথায় বিশৃঙ্খলা ও মানবিক বিপর্যয় অবধারিত। উচ্চতম ও নিম্নতম সীমার মধ্যে ব্যবধান যদি আকাশ পাতাল হয় তবে সেটা নিচের দিকের মানুষদের জন্য হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে। বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ বেতন কাঠামো। বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি সকল পর্যায়ের উদ্যোগ।
রিয়াজ উদ্দিনঃ লেখক ও ব্যাংকার
ইমেইলঃ riyazenglish@gmail.com