বর্তমানে আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার সংকটের মধ্যে রয়েছে। এরই মধ্যে মহামারির প্রভাব কিছুটা নিম্নমূখী হওয়াতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় পণ্যের চাহিদা বাড়ছে অনেক, কিন্তু অতিমাত্রায় চাহিদা থাকলেও সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না ।
২৮টি পণ্যের ভবিষ্যৎ সরবরাহ দাম নিয়ে রেফিনিটিভ কোরকমোডিটি সিআরবি মূল্যসূচক প্রকাশিত হয়। গত মাসে এ মূল্যসূচক ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। ১৯৯৫ সালের পর এটি সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।
বেশির ভাগ পণ্যের ক্ষেত্রেই দাম বাড়ছে। বিশেষ করে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও অন্যান্য জ্বালানি পণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়েছে। ২২টি প্রধান পণ্যের মধ্যে নয়টির দাম ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। কফিসহ জনপ্রিয় পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে ৯১ শতাংশ। তুলার দাম ৫৮ ও অ্যালুমিনিয়ামের দাম ৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২০ সালে মহামারীর প্রভাবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদা তলানিতে নেমে আসে। কিন্তু গত বছর পরিস্থিতি ইতিবাচক দিকে মোড় নেয়ায় জ্বালানি পণ্যটির চাহিদায় উল্লম্ফন দেখা দেয়। আগামী বছরগুলোয়ও চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু কার্বন নিঃসরণ প্রতিরোধে শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলো পণ্যটির সরবরাহ খাতে বিনিয়োগ করা থেকে সরে আসছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সরবরাহ চেইনে প্রতিবন্ধকতা ও শ্রমিক সংকট সরবরাহ ও চাহিদা ভারসাম্যের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে পণ্যবাজার চাপের মুখে পড়ায় বেশকিছু নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। অ্যালুমিনিয়াম বিগলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাপক পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ ও উৎপাদন ব্যয় বাড়তে থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান ধাতুটির উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ কারণে অ্যালুমিনিয়ামের সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। সার উৎপাদনের প্রধান উপকরণ অ্যামোনিয়া। প্রাকৃতিক গ্যাসের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে বাড়ছে এটির বাজারদরও। এ কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদন ব্যয় কৃষকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে এসব পণ্যের দামও হয়ে উঠছে আকাশচুম্বী।
পণ্যবাজারে এমন ঊর্ধ্বগতি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছে। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের প্রাক্কলন অনুযায়ী, বর্তমানে জ্বালানি পণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট করে কমতে পারে।
কাঁচামাল উৎপাদনের দিক থেকে যেসব দেশ পিছিয়ে আছে, তাদের জন্য পণ্যবাজারের এমন অস্থিতিশীলতা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পণ্যবাজারে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে যেসব দেশ, তার মধ্যে অন্যতম তুরস্ক। দেশটি চাহিদার ৭০ শতাংশ জ্বালানিই আমদানি করে। গত মাসে দেশটির ভোক্তা মূল্যসূচক ৪৯ শতাংশ বেড়েছে। জানুয়ারির শুরু থেকেই দেশটির শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধি এবং জনগণ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে আসছে। বছরের শুরুতে মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তাতে দেশটির সরকারের পতন ঘটে। নতুন করে দেখা দিয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেন সংকট।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ) জানায়, ২০১৯ সালে বিশ্বের ১৪৩টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ৪৭টিই তাদের জ্বালানি চাহিদার অর্ধেকের বেশি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করেছে।
পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজার সব ধরনের খাদ্যকে ব্যয়বহুল করে তুলছে। জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে থাইল্যান্ডে শূকরের মাংসের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সয়াবিন ও ভুট্টার অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এদিকে কাঁচামালসমৃদ্ধ ইন্দোনেশিয়া কয়লা ও পাম অয়েল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। সূত্র- নিক্কেই এশিয়া।