গত অর্থবছরের প্রায় পুরোটাই নেতিবাচক ধারায় ছিল দেশের রফতানি খাত। এর মধ্যেই মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে মার্চে এ নেতিবাচক ধারা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এপ্রিলেও তা হ্রাস পায় ব্যাপক হারে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি দেখা যায় মে মাসে, যা জুনেও অব্যাহত ছিল। তবে সার্বিকভাবে গোটা ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি কমে যায় ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
এদিকে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাসে প্রবৃদ্ধি হলেও তা ছিল ১ শতাংশের নিচে। তবে আগস্টে প্রবৃদ্ধি হয় ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ নিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু অক্টোবরে আবারো ঋণাত্মক হয়েছে প্রবৃদ্ধি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদন বলছে, অক্টোবরে দেশের রফতানি হ্রাস পেয়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
তবে অক্টোবরে একক মাস হিসেবে রফতানি হ্রাস পেলেও অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সার্বিকভাবে কিছুটা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে রফতানি খাত, যদিও তা ১ শতাংশেরও নিচে। ইপিবির প্রতিবেদন বলছে, অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশ থেকে মোট ১ হাজার ২৮৪ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৭২ কোটি ১২ লাখ ২০ হাজার ডলার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ।
ইপিবির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুধু জুলাই মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল। ডিসেম্বর মাস ছাড়া আগস্ট থেকে জুন সবগুলো মাসেই রফতানি নেতিবাচক ছিল। এরপর চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই মাসে অর্থাৎ টানা ছয় মাস পর রফতানি বেড়েছে বা ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়।
দেশের রফতানি খাতের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে। ইপিবির হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের মোট রফতানিতে তৈরি পোশাকের অংশ ছিল প্রায় ৮১ শতাংশ। মূলত তৈরি পোশাক পণ্যের রফতানি কমার প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে সার্বিক রফতানিতে।
পোশাক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) পোশাক রফতানি হ্রাস পেয়েছে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। টানা সাত মাস পতনের পর চলতি বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে কিছুটা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসে খাতটি। এরপর আবার গত মাসে তৈরি পোশাকের রফতানি হ্রাস পায় ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা খাতটির বৈশ্বিক চাহিদা ও বাণিজ্য পুনরুদ্ধার নিয়ে শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, অক্টোবরে রফতানির এ বড় পতনের কারণেই চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তৈরি পোশাক খাতের রফতানি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ঋণাত্মক ১ দশমিক ২ শতাংশে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর বক্তব্য হলো, ওভেন পোশাক রফতানি কমার কারণেই সার্বিকভাবে তৈরি পোশাকের মোট রফতানিতেও পতন হয়েছে। বিষয়টি উদ্বেগের। আলোচ্য সময়ে নিটওয়্যারের রফতানিতে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ওভেন পোশাক রফতানি কমেছে ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অক্টোবরে যেখানে নিটওয়্যারের রফতানি কমেছে ২ দশমিক ১৯ শতাংশ, সেখানে ওভেন পোশাক রফতানি কমেছে ১৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, যদিও অক্টোবর মাসের দেশভিত্তিক রফতানি তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্যে দেখা গেছে, অপ্রচলিত বাজারগুলোয় রফতানি নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বেশি। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি আমাদের রফতানিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এখন যেহেতু ইউরোপে করোনার নতুন ঢেউ শুরু হয়েছে, সে কারণে ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও গ্রিসসহ বেশকিছু দেশ লকডাউন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ইউরোপে পোশাকের চাহিদা যদি আরো জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে, তাহলে আমাদের জন্য খাপ খাইয়ে নেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে। ইউরোপ আমাদের প্রধান বাজার, এ কারণেই বিষয়টি উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রফতানি মূল্যে চাহিদা পতনের প্রভাব এনবিআরের তথ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে রুবানা হক বলেন, অক্টোবরে আমাদের পোশাকের মূল্য গড়ে ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে কমেছে। জুলাই-অক্টোবর সময়সীমায় তা হ্রাস পেয়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। কভিড-১৯-এর কারণে আমাদের কারখানাগুলো মারাত্মক আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছে। যেখানে গোটা শিল্পেই এখন হেলথ প্রটোকল বজায় রাখতে গিয়ে নির্দিষ্ট কিছু ব্যয় ধরে রাখতে হচ্ছে, সেখানে মূল্যের এ পতন আমাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান রফতানি গন্তব্য আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশভুক্ত প্রতিটি দেশকেই কভিড-১৯-এর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিজিএমইএ বলছে, বাতিল-স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশের ৮০ শতাংশের বেশি পুনর্বহাল হলেও সেগুলোর সময়সীমা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। কারখানা মালিকরা বলছেন, বাতিল বা স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশগুলোর কিছু ফিরে এসেছে। আবার নতুন ক্রয়াদেশও পেতে শুরু করেছে কারখানাগুলো। কিন্তু তা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম।