চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় গত ডিসেম্বরে। এরপর ভাইরাসটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে পর্যটন শিল্প। ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চীন কয়েক ডজন শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একই সঙ্গে চীন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কতা জারি করে বহু দেশ। যার পরিপ্রেক্ষিতে বহু এয়ারলাইন তাদের শিডিউল ছেঁটে ফেলতে বাধ্য হয়। চীনে ফ্লাইট বাতিল করে এয়ার কানাডা, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, ডেল্টা ও লুফথানসার মতো বড় এয়ারলাইনসগুলো।
এরই মধ্যে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে হংকংয়ের এয়ারলাইন ক্যাথে প্যাসিফিক। গত বুধবার ২৭ হাজার কর্মীকে তিন সপ্তাহের অবৈতনিক ছুটি নিতে বলেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ। এছাড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ম্যাকাওয়ের ক্যাসিনোগুলো। এসব ক্যাসিনো মূলত চীনের বিত্তশালীদের প্রমোদস্থল। একইভাবে বন্ধ রয়েছে সাংহাই ও হংকংয়ে ডিজনির থিমপার্ক।
এদিকে ফ্রান্সের প্যারিসের বিপণিবিতানগুলো অনেকটাই নীরব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনা পর্যটকদের অভাবে এসব দোকানে এখন বেচাকেনা অনেকাংশেই কমে গেছে। এছাড়া করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়ছে ইতালির পর্যটন খাতেও। ডেমোসকোপিকার তথ্যমতে, চলতি বছর দেশটির পর্যটন খাতে ৪৫০ কোটি ইউরো ক্ষতি হতে পারে।
ভাইরাসের কারণে চীনজুড়ে বহু পৃক্ষাগৃহ বন্ধ রয়েছে। এগুলো এমন সময়ে বন্ধ রয়েছে, যখন উত্সবের ছুটি উপলক্ষে উপচে পড়া ভিড় থাকার কথা। ফলে কানাডাভিত্তিক আইম্যাক্স করপোরেশনের বক্স অফিস আয়ে ক্ষতি হতে পারে ৬ থেকে ২০ কোটি ডলার।
করোনাভাইরাসের কারণে একইভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে ইলেকট্রনিকস শিল্প। এরই মধ্যে তাইওয়ানের টেক জায়ান্ট ফক্সকন চীনে তাদের কারখানাগুলো মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি তারা তাদের কিছু কর্মীকে অতিরিক্ত আরো ১৪ দিন অন্যদের থেকে আলাদা থাকার জন্য বলেছে। এ পদক্ষেপ প্রতিষ্ঠানটির ওপর নির্ভরশীল বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য উৎপাদনপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এরই মধ্যে মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। ২৪-২৭ ফেব্রুয়ারি বার্সেলোনায় অনুষ্ঠেয় এ সম্মেলনে যোগ দেয়া নিয়ে এখনো পরিস্থিতি পর্যবক্ষেণ করছে চীনা মোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে।
ইলেকট্রনিকসের পর করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে বৈশ্বিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার কেন্দ্র উহান যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি নির্মাতাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া চীনে আরো বহু শহরে সংক্রমণ ক্রমে ছড়িয়ে পড়ায় গাড়ি নির্মাণ খাতে অস্থিরতা বাড়ছেই। হুন্দাই জানিয়েছে, চীন থেকে যন্ত্রাংশ সরবরাহে ঘাটতির কারণে তারা দক্ষিণ কোরিয়ায় উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছে। অন্যদিকে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা বলছে, ভাইরাসের কারণে চীনের সাংহাইয়ে তাদের নতুন কারখানায় উৎপাদন ত্বরান্বিত করার পরিকল্পনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তাদের চলতি প্রান্তিকের আয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের কফি চেইন স্টারবাকসের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার চীন। দেশটিতে স্টারবাকসের দোকান রয়েছে চার হাজারের বেশি। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে প্রায় অর্ধেক দোকান। এছাড়া হুবেই প্রদেশে কয়েকশ রেস্তোরাঁ বন্ধ রেখেছে ম্যাকডোনাল্ড’স। বিক্রি কমে গেছে পিত্জা হাট ও কেএফসির মতো চেইন খাদ্য কোম্পানির।
এদিকে ইউরোপীয় উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস বেইজিংয়ের পূর্বাঞ্চলে তিয়ানজিনের কারখানায় তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। একইভাবে তিয়ানজিন ও চীনের অন্য অঞ্চলে নিজেদের কারখানায় হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন ও উড়োজাহাজের উৎপাদন বন্ধ রেখেছে ফরাসি গ্রুপ সাফরান।
করোনাভাইরাসের কারণে চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে ভারী যন্ত্র নির্মাতা কোম্পানি ক্যাটারপিলার। একইভাবে চীনে কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছে নাইকি। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি চীনে তাদের অর্ধেক দোকান বন্ধ করে দিয়েছে, কমে গেছে খুচরা বিক্রি। ভাইরাস সংক্রমণের কারণে চীনে বিক্রি কমে গেছে ক্রীড়াসামগ্রী উৎপাদনকারী জার্মান কোম্পানি এডিডাসেরও। তবে সব কোম্পানি যে করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে তা নয়। প্রতিরক্ষামূলক ফেস মাস্ক উৎপাদনকারী কোম্পানির জন্য এখন বেশ সুবর্ণ সময় চলছে।